রংপুরের স্বপ্নপথ, সিলেটের অঙ্কভাঙা এবং এনসিএলের শেষদিনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা

৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল

প্রকাশ: 1 ঘন্টা আগে আপডেট: 1 সেকেন্ড আগে
রংপুরের স্বপ্নপথ, সিলেটের অঙ্কভাঙা এবং এনসিএলের শেষদিনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা

রংপুরের স্বপ্নপথ, সিলেটের অঙ্কভাঙা এবং এনসিএলের শেষদিনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা

রংপুরের স্বপ্নপথ, সিলেটের অঙ্কভাঙা এবং এনসিএলের শেষদিনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা

বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এমন অনেক মৌসুম আসে না যেখানে শেষ রাউন্ডে এসে শিরোপার হিসাবকে গ্র্যান্ডমাস্টারের দাবার মতো জটিল মনে হয়। এবারের জাতীয় ক্রিকেট লিগ এমনই এক মৌসুম, যেখানে প্রতিটি সেশন, প্রতিটি ওভার, এমনকি একেকটি ভুল শটও শেষমেশ ট্রফির দিকনির্দেশ বদলে দিতে পারত। এই প্রেক্ষাপটে রংপুর বিভাগের জয়টি শুধু একটি ম্যাচ জেতা নয়, বরং বহুমাত্রিক এক বিবৃতি। তাদের পারফরম্যান্সের ভিতর ছিল পরিকল্পনার স্থিরতা, বাস্তবায়নের নির্ভুলতা এবং সবচেয়ে বড় কথা, প্রয়োজনীয় সময়ের প্রয়োজনীয় কঠোরতা।

রংপুরের এই জয়কে বোঝার জন্য প্রথমেই আসতে হয় ম্যাচের তৃতীয় দিনের সকালে। খুলনা যখন ৫ উইকেটে ৪১ রান নিয়ে শুরু করে, তখন তাদের সামনে যে চাপ ছিল তা বোঝা যায় ব্যাটারদের দেহভঙ্গিতেই। লিগের শেষদিকে এসে ধারাবাহিকতার অভাব ক্রিকেটকে নিষ্ঠুর করে তোলে। আর রংপুরের পেসার মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ সেই নিষ্ঠুরতাকে আরও প্রকট করে দিলেন অসাধারণ এক স্পেল দিয়ে। সিমের ওপর নিয়ন্ত্রিত দক্ষতা, অফ স্টাম্পের ধার বরাবর নিরবচ্ছিন্ন প্রশ্ন এবং ব্যাটারদের মানসিক নাজুকতাকে টার্গেট করে তিনি খুলনার ব্যাটিং লাইনআপকে প্রায় একাই ভেঙে দেন। তার টানা তিন ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং রংপুরের শিরোপাস্বপ্নের সবচেয়ে শক্ত ভিত।


তারপর আসে ইকবাল হোসেনের ব্যাটিং। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম শতক সাধারণত একজন ব্যাটারের আরামদায়ক যাত্রার চিহ্ন। কিন্তু ইকবালের ইনিংস তার অনেক বেশি কিছু। সেটি ছিল চাপ সামলে দাঁড়ানোর এক শিক্ষা। রংপুরের ড্রেসিংরুমে যখন এ মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয় নিশ্চিত করার তাগিদ ছিল, ইকবাল তখন ব্যাটে এনে দেন আশ্চর্য শান্তি। নাঈম ইসলামের সঙ্গে তার ৯৩ রানের জুটি ছিল রংপুরের শিরোপার পথের মূল বাঁক। এই ইনিংস শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং রংপুরের ভবিষ্যৎ ব্যাটিং কাঠামোতেও প্রয়োজনীয় আলো যোগ করবে।


রংপুরের অবস্থান এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে সিলেটের পরিস্থিতি যেন ছায়ার মতো পাশাপাশি থাকলেও রংপুরের উজ্জ্বল আলোতে ঢেকে যাচ্ছে বারবার। সিলেট মৌসুমজুড়ে ধারাবাহিক ছিল, তবে শেষ রাউন্ড তাদের সামনে কঠিনতম পরীক্ষাই নিয়ে এসেছে। রাজশাহীতে বরিশাল যে লিড তৈরি করেছে, তা কেবল বড় নয়, তা মানসিক চাপেরও প্রতীক। লিড যখন ২৩৭ এবং ব্যাট করার মতো উইকেট এখনও ছয়টি, তখন প্রতিপক্ষের ভেতর যে উদ্বেগ জন্মায়, সেটাই এখন সিলেটের বাস্তবতা। তাদের সামনে যে সমীকরণ দাঁড়িয়েছে তা নিছক ম্যাচ জয়ের নয়, বরং ক্লান্ত শরীর এবং ধকল খাওয়া মনকে এক সেশনের পর আরেক সেশনে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন। এমন সমীকরণ লিগের শেষ রাউন্ডে পূরণ হয় খুব কম ক্ষেত্রেই।


এই সময়টায় ঢাকার জয়টিও যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। যদিও তারা শিরোপা লড়াইয়ের বাইরে, তবু চট্টগ্রামের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে দাপুটে জয় দেখিয়ে দেয় দীর্ঘ ফরম্যাটে অভিজ্ঞতা এবং স্থায়িত্ব কীভাবে ম্যাচের ছবি বদলে দিতে পারে। ঢাকার আনিসুল ইসলাম ইমন (১৮৬), শামসুর রহমান শুভ (১৬৫), এবং ওপেনার আশিকুর রহমান শিবলি (১০০) তিন সেঞ্চুরি কেবল একটি বড় ইনিংস নয়, লিগের মানদণ্ডকে উঁচুতে রাখারও প্রমাণ। বড় স্কোর কখনও কখনও লিগের অন্য ম্যাচগুলোর ওপরও চাপ তৈরি করে, যা পরোক্ষভাবে রংপুর এবং সিলেটের ম্যাচগুলোকেও মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে।
ময়মনসিংহের বিরুদ্ধে রাজশাহীর অগ্রগতিও লিগের চিত্রকে আরেকভাবে অর্থবহ করে। আবু হায়দার রনির লড়াইটি ছিল প্রশংসিত হওয়ার মতো, তবে ম্যাচ পরিস্থিতি যে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, সেখানে ব্যক্তিগত ইনিংসগুলো অনেক সময় সান্ত্বনার স্তম্ভ হয়ে থাকে। ময়মনসিংহের লড়াই মূলত এখানেই শেষের দিকে ঝুলে থাকা প্রদীপের মতো।


সবশেষে আসা উচিত মানবিক মুহূর্তটির কথায়। শামসুর রহমান শুভর বিদায়ের দৃশ্যটি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় লিগে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। যখন দুই দলের ক্রিকেটাররা তাকে গার্ড অব অনার দিলেন, সেটা বোঝায় ক্রিকেট শুধু স্কোরবোর্ড নয়, এটি স্মৃতি, সম্মান এবং আচরণের এক বিশাল ক্ষেত্র। লিগের উত্তেজনার মাঝেও এমন মুহূর্ত দেখায় আমাদের ক্রিকেটের শিকড় এখনও সম্মানবোধে ভরপুর।


সব মিলিয়ে বলা যায়, রংপুর এখন শিরোপার সবচেয়ে কাছে, আর তাদের এই অবস্থানে পৌঁছানোর পথটি শুধুই অর্জনের নয়, বরং পরিকল্পনা, অধ্যবসায় এবং সঠিক সময়ে সঠিক পারফরম্যান্স তুলে ধরার গল্প। সিলেট চাইলে সমীকরণ বদলে দিতে পারে, কিন্তু ক্রমশই তা কঠিন হয়ে উঠছে। এনসিএলের এই মৌসুম তাই শেষ রাউন্ডেও এক প্রশ্ন রেখে গেছে। রংপুরের অপেক্ষা কি উৎসবে বদলাবে, নাকি সিলেটের লড়াই শেষ দিনে নাটকের জন্ম দেবে। ক্রিকেটের সৌন্দর্য এখানেই যে উত্তরগুলো সবসময় শেষ সেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখে।