ফিরে আসার গল্প: ব্যাট হাতে নয়, এবার কোচ হিসেবে মোহাম্মদ আশরাফুল
৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল
প্রকাশ: 3 ঘন্টা আগে আপডেট: 1 সেকেন্ড আগে
ফিরে আসার গল্প: ব্যাট হাতে নয়, এবার কোচ হিসেবে মোহাম্মদ আশরাফুল
ফিরে আসার গল্প: ব্যাট হাতে নয়, এবার কোচ হিসেবে মোহাম্মদ আশরাফুল
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম নায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। দেশের ক্রিকেটের প্রথম ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে যিনি এক সময় সমর্থকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে কার্ডিফে তাঁর বীরোচিত সেঞ্চুরি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় এনে দিয়েছিল, যা আজও দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম গৌরবগাথা। কিন্তু সেই নায়কের নামই পরে জড়িয়ে যায় বিপিএলের ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে। নিষেধাজ্ঞার শাস্তি ভোগ শেষে তিনি ফিরেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, তবে জাতীয় দলে আর ফেরা হয়নি খেলোয়াড় হিসেবে। এবার তিনি ফিরেছেন নতুন ভূমিকায়, বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে তাঁকে ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
মিরপুরে বৃহস্পতিবার দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে শুক্রবার সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আশরাফুল। সেদিন তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা মানুষের একটা স্বপ্ন থাকে। যেহেতু আমি ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরে ঠিক করেছিলাম যে ক্রিকেট কোচ হব। যেহেতু আমার জীবনে অনেকগুলো ভাল ইনিংস আছে, এবং খারাপ ইনিংসও আছে। এই জিনিসগুলো আমি শেয়ার করতে চাই। এই কারণেই আমি আসলে কোচিংয়ে আসতে চেয়েছি।”
তিন বছর আগে আবুধাবিতে নিজের খরচে সম্পন্ন করেছিলেন লেভেল থ্রি কোচিং কোর্স। এরপর রংপুর রাইডারস, গ্লোবাল টি-২০, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও মেয়েদের লিগসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাঁর ভাষায়, “রংপুর রাইডারস আমাকে খুবই ভাল একটা সুযোগ দিয়েছে। গ্লোবাল টি২০তে কাজ করেছি, সেখানে আমরা গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলাম, তারপর বিপিএল। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, মেয়েদের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ—গুলশান ইয়ুথের কাজ করেছি। এর মাঝে মাঝে কয়েকটা ক্লাবেও কোচিং করিয়েছি।”
জাতীয় দলের ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিকতা নিয়েই আশরাফুলের সবচেয়ে বড় ভাবনা। তিনি বলেন, “আমাদের ব্যাটাররা প্রত্যেক সেকেন্ড ইনিংসে বড় বড় রান করবে, এটাই আমার ইচ্ছা। আমাদের যে দল, যে প্লেয়ার, সবাই খুব ট্যালেন্টেড এবং এক্সাসাইটিং প্লেয়ার। সবাই পারফর্মার, সবাই পারফর্ম করে। হয়তো দুই ম্যাচ, তিন ম্যাচ পরপরই, সেটা কীভাবে ধারাবাহিকভাবে করা যায়, যদিও আমি করতে পারিনি আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে, কিন্তু তারা কিভাবে করতে সেই জিনিসটাই আমি শেয়ার করার চেষ্টা করব এই সিরিজটাতে।”
খেলোয়াড়দের তুলনায় কোচের চাপ কম বলেই মনে করেন আশরাফুল। তাঁর ব্যাখ্যা, “খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলে ডুকলে বেশি চাপ থাকে। কারণ আপনাকে পারফর্ম করতে হবে। সবাই, পুরো ১৮ কোটি মানুষ, আপনার ব্যাটিং-বোলিং পারফরম্যান্সটা জাজ করে। কোচের জাজমেন্ট আসলে দল পারফর্ম না করলে তখন আসে যে দল পারফর্ম করতে পারছে না, তাই এই কোচ ভাল না। আসলে ম্যাচে কোচের আসলে কিছু করার থাকে না। প্লেয়ারদের আপনি হয়তো বলে দিতে পারবেন যে, এই পরিস্থিতিতে এটা দল এটা চাচ্ছে। কিন্তু মাঠে পরিস্থিতি বুঝে গেম প্লান বাস্তবায়ন তো করতে হবে ক্রিকেটারদের।”
জাতীয় দলের প্রধান কোচ ফিল সিমন্সের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গল্পটিও বেশ অনন্য। আশরাফুল স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৮ সালে। তখন আমি বলবয় ছিলাম, উইলস কাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল রানার্সআপ হয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন নকিংয়ের সময় সিমন্সকে আমি একটা বল করেছিলাম, দ্বিতীয় বল আমি গুগলি করি। সিমন্স তখন গুগলিটা বুঝতে পারেননি। তখন রয়াল লুইস এনে বলেছিলেন, প্রত্যেক দিন খেলা শেষে যেন আমার আধা ঘণ্টা করে বোলিং করেন, আর আমার কাছ থেকে যেন গুগলিটা শেখে। সেই থেকেই ফিল সিমন্সের সাথে আমার সম্পর্ক।”
এক সময়ের সতীর্থ মুশফিকুর রহিম এখন শততম টেস্টের দ্বারপ্রান্তে। মুশফিকের অভিষেকেও ছিলেন আশরাফুল, এবার তাঁর শততম ম্যাচেও থাকছেন কোচ হিসেবে। আশরাফুল বলেন, “আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি, যে আল্লাহ আমাকে এমন সময় সুযোগ দিয়েছেন। যখন মুশফিক প্রায় একশো টেস্ট ম্যাচ খেলার দ্বারপ্রান্তে, আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি মুশফিকের প্রথম টেস্টে ড্রেসিংরুমে ছিলাম, লর্ডসে। এবং মুশফিকের ৯৯ এবং ১০০তক টেস্টেও আমি থাকব। এই জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। মুশফিক সেই ছোটোবেলা থেকে যেহেতু দেখেছি, একমাত্র ক্রিকেটার যার ডিসিপ্লিন ছিল বলেই সে বিশ বছর ধরে খেলছে। আমার ব্যক্তিগত মত যে, বাংলাদেশে এখনও যারা খেলছেন, ভবিষ্যতে যারা আসবেন, সবার আসলে মুশফিককে রোল মডেল হিসেবে দেখা উচিত।”
কোচ হিসেবে নিজের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনাতেও তিনি শান্ত। রুবেল হোসেনের সমালোচনামূলক ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে আশরাফুলের জবাব, “যার যার ব্যক্তিগত মতামত দিতেই পারে, এটা নিয়ে আমার বলার কিছু নাই। সে আমার অধীনেই জাতীয় দলে খেলেছে, সে মানুষ হিসেবে খুবই ভাল। এটা আমি জানি। এ বিষয় নিয়ে আমার বলার কিছু নাই।”
নিজের দায়িত্ব ও প্রত্যাশা সম্পর্কে আশরাফুল বলেন, “চাপ তো অবশ্যই থাকবে, রেজাল্ট ওয়ারিয়েন্টেড কাজ করতে গেলে অবশ্যই আপনাকে চাপ সহ্য করতে হবে। যেহেতু আমি তেরো বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছি সেহেতু আমি এই চাপ অনেক সহ্য করেছি। এবং আমার জীবনে একটা চাপ এসেছিল, সেই চাপ থেকেই কিন্তু আমি ফিরে এসেছি। এই বিষয় নিয়ে আসলে আমি এতোটা চিন্তিত না। আমি যেখানে যাই, সেখানেই সবসময় নিজের সততা দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। নিজের শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করি।”
সিলেটের উইকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সিলেটে আমরা টি-টোয়েন্টি খেলেছি। অবশ্যই দেশের অন্য যেকোনো জায়গায় চেয়ে কন্ডিশন ভিন্ন, বিশেষ করে উইকেট। আমরা চাইলে সেখানে স্পিন উইকেট বানাতে, আবার বাউন্সি উইকেটও বানাতে পারি। আসলে এখন আমি এটা বলতে পারব না, আসলে ম্যানেজমেন্ট কী চায়! চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে গেলেই তো আপনাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।”
সবশেষে মিডিয়া ও সমালোচনা প্রসঙ্গে আশরাফুলের অনুরোধ, “একটা সময় আমরা অপেক্ষা করতাম নিউজের জন্য, রাত আটটা, নয়টা। সকালে পত্রিকার জন্য। এখন তো প্রত্যেক সেকেন্ডেই নিউজ হয়ে যাচ্ছে, আপনি কী করছেন না করছেন। তাই এটা প্রত্যেকটা মানুষের জন্য কঠিন। আমার একটাই আশা থাকবে আপনাদের কাছে, আপনারা অবশ্যই সমালোচনা করবেন। একটু রয়েসয়ে সমালোচনা করলে ভাল হয়। আসলে সবাই চায় সেরাটা দিতে, এই জায়গায় সমালোচনাটা হবে এটা আমি জানি, এটা স্বাভাবিক। আসলে এটাই জীবন, আপনি ভাল করলে আপনাকে আকাশে উঠাবে, খারাপ করলে নিচে নামাবে। এটাই জীবন।”
মোহাম্মদ আশরাফুলের এই প্রত্যাবর্তন শুধু পেশাগত নয়, এক প্রতীকী গল্পও বটে। পতন থেকে উঠে আসা, নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া এবং তরুণদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার গল্প। কার্ডিফের নায়ক এখন ড্রেসিংরুমে নতুন মিশনে, এবার ব্যাট হাতে নয়, দায়িত্বের বোর্ড হাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেক অধ্যায় লিখতে চান তিনি।
