Image

পাপন-হাথুরুসিংহের দেখানো পথেই কী হাঁটছেন ফারুক-সিমন্সরা

৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল

প্রকাশ : 6 দিন আগেআপডেট: 1 সেকেন্ড আগে
পাপন-হাথুরুসিংহের দেখানো পথেই কী হাঁটছেন ফারুক-সিমন্সরা

পাপন-হাথুরুসিংহের দেখানো পথেই কী হাঁটছেন ফারুক-সিমন্সরা

পাপন-হাথুরুসিংহের দেখানো পথেই কী হাঁটছেন ফারুক-সিমন্সরা

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের একাদশে শেষ কবে এক পেসার খেলেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অবশ্যই বেশি দূর যেতে হবে না। তার উত্তর আছে হাতের নাগালেই, কারণ সেই ম্যাচের সময়কালও যে বছর পার হয়নি। তাই দিন-তারিখ-মাস ভুলে যাবার কথা নয়, জয়ী ম্যাচের স্মৃতি তো আবার মনে পড়ে বেশি!

আর সেই এক পেসার নিয়ে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছিল গেল নভেম্বরে। সিলেটে তাইজুল ইসলামের স্পিন ঘুর্ণিতে সেই ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। তবে এবার অবশ্য জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ঢাকা টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক পেসার নিয়ে খেলতে নেমে স্বাগতিকরা হেরেছে ৭ উইকেটে। 

ঘরের মাঠে বাংলাদেশের স্পিন নির্ভরতা বেশ পুরনো, স্পিন সহায়ক উইকেটে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকাকে কাবু করার কৌশলটা শিখিয়েছিলেন টাইগারদের দুই মেয়াদের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বিদেশে গিয়ে দল যখন ভাল ফলাফল করতে ব্যর্থ হত, বাজে খেলার ফলে যখন হারের বৃত্তে ঘুরপাক খেত তখন এর থেকে বের হওয়ার উপায় হিসেবে ঘরের মাঠে স্পিন উইকেটই বেছে নিতেন কোচ। সেখানে মোটাদাগে সম্মতি থাকত সাবেক বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনের। 

আর এমনটা পাপন-হাথুরুসিংহে করতেন যেকোনো বিদেশ সফরের ব্যর্থতা ঢাকতে।  যেমনটা করেছিলেন গেল নভেম্বরে, ২০২৩ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার দুঃসহ স্মৃতি ভুলাতেই স্পিন নির্ভর উইকেট বানিয়ে সিলেটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক পেসার নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।  

সেখানেও বেশ সফল কোচ, তাইজুল ইসলামের স্পিন ঘুর্ণিতে দারুণ এক জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের টেস্টেও এক পেসার খেলানোর থিওরিতে অটল ছিল বাংলাদেশ। সেখানেও সায় দেয় নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ড। তবে সেই ম্যাচে অবশ্যই ভেস্তে যায় পাপন-হাথুরুহিংহের পরিকল্পনা। স্পিনাররা দাপট দেখালেও ব্যাটারদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশ ম্যাচ হারে ৪ উইকেটে। 

এমনটা হাথুরুসিংহে করেছেন তার আগের মেয়াদেও, সাফল্যও পেয়েছেন বেশ। তবে মোটাদাগে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কোনো উন্নতি হয়নি। দেশে মিরপুরের বাইরে খেলতে গেলেই ম্যাচের চিত্রপট পালটে যেত হরহামেশাই। আর বিদেশে টেস্ট খেলতে গেলে তো কোনো কথাই নেই। 

দেশের ক্ষমতার পালাবদলে দেশের ক্রিকেটেও বড়সড় পরিবর্তন এসেছে। নাজমুল হাসান পাপনের জায়গায় বিসিবির সভাপতি হয়েছেন সাবেক অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। কোচ হাথুরুসিংহেকেও বরখাস্ত করে নতুন কোচ হিসেবে ক্যারিবীয় ফিল সিমন্সকে নিয়োগ দিয়েছে ফারুক আহমেদের বোর্ড। 

কোচ-সভাপতির নাম অদলবদল হলেও কাজের পরিধিতে আদতে কোনো পরিবর্তন আসেনি বাংলাদেশের খেলায়। আগে যেমন বিদেশ সফরের ভরাডুবি ঢাকতে দেশের মাটিতে নিজেদের পছন্দসই উইকেট বানিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে স্পিনটাকেই প্রাধান্য দিত, এখনও তাই করা হচ্ছে। ফারুক-সিমন্স জুটি তাই হাটছেন পাপন-হাথুরুসিংহের দেখানো পথেই। 

ভারত সফরের ব্যর্থতা ঢাকতে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভাল খেলার বিকল্প নাই। আর সেখানে যদি নিজেদের কন্ডিশন কাজে লাগিয়ে, নিজেদের মতো করে উইকেট বানিয়ে একটা জয়ের তুলে নেওয়া যায় তাহলে ভারতের বিপক্ষে হার সহজে ভুলানো যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের। সেই ভাবনায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে স্পিনিং উইকেটে খেলে বাংলাদেশ। হাথুরুসিংহের এক পেসার থিওরিতেই আছেন ফারুক-সিমন্সরা।

তবে আদতে কোনো লাভ হয়নি, বরং নিজেদের স্পিনারদের চেয়ে এমন উইকেটেও প্রোটিয়া পেসারদের দাপটই দেখেছে বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের পড়া ২০ উইকেটের ১৬টি নিয়েছেন আফ্রিকান পেসাররা। বাংলাদেশ এক তাইজুল ইসলাম ছাড়া অন্য স্পিনাররা তেমন একটা সাফল্য পাননি। বিপরীতে প্রোটিয়া পেসার কাগিসো রাবাদা পেস নাজেহাল করেছে স্বাগতিক ব্যাটারদের, দুই ইনিংসে মিলিয়ে তার সংগ্রহ ৯ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রানে নিয়েছেন ৬ উইকেট, পাশাপাশি এই ম্যাচে ছুয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে ৩০০ উইকেটের মাইলফলক। 

রাবাদার মতো ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে দুইশো উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন বাংলাদেশের তাইজুল ইসলামও। ইনিংসে নিয়েছেন ৫ উইকেট, দুই ইনিংস মিলিয়ে তার শিকার ৮ উইকেট। তাইজুলের বাইরে বাংলাদেশ দলে আলোচনাটা কেবল মুশফিকুর রহিমের ৬০০০ রানের মাইলফলকের। দ্বিতীয় ইনিংসে সপ্তম উইকেটে ১৩৮ রানের জুটি গড়ার পথে মেহেদী হাসান মিরাজ (৯৭) ও জাকের আলী অনিকের (৫৮)। এই জুটি বাদ দিলে ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে বলার মতো তেমন অবদান নাই। এই জুটিতেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে সংগ্রহ করে ৩০৭ রান। প্রথম ইনিংসে ২০২ রানে পিছিয়ে থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় মাত্র ১০৬। টনি ডি জর্জি ৪১ আর ট্রিস্টান স্টাবসের (৩০*) ব্যাটে ৭ উইকেটের বিশাল জয়ে সিরিজ শুরু করে সফরকারীরা। 

টেস্টে দেশের মাটিতে নিজেদের পছন্দসই উইকেট বানিয়ে বাংলাদেশ এরকম সফরকারী দলকে ফাঁদে ফেলে আসছে বহু বছর ধরে। হোম কন্ডিশনের ফায়দা নেওয়া দোষের কিছু না, এটা সব দেশেই নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশই সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, কাজে লাগাচ্ছে।

তবে এমন উইকেট বানিয়ে দেশের মাঠে এক দুইটা ম্যাচ জেতা যায়, সাথে ভাগ্য সহায় হলে সিরিজটা লুফে নেওয়া যায়। কিন্তু এমন ম্যাচ জয় কিংবা সিরিজ জয় আদতে কী দেশের ক্রিকেটের উন্নতি হচ্ছে? প্রশ্ন থেকেই যায়!

আসলে তেমন একটা উন্নতি হচ্ছে না। দেশের মাঠে নিজেদের পছন্দসই উইকেট বানিয়ে ম্যাচ জয়ের প্রবণতা বাংলাদেশ শুরু সেই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের আমল থেকেই। দ্বিতীয় মেয়াদে কোচ হয়েও একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন হাথুরুসিংহে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে, সেই ফায়দা কাজে লাগিয়ে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ হারিয়েছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে। 

২০১৬ সালে মেহেদী হাসান মিরাজের অভিষেক সিরিজে দুর্দান্ত বোলিংয়ে প্রথমবার ইংল্যান্ডকে হারানোর পর নিজেদের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে তাদের ডেরায় হারায় টাইগাররা। বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে প্রথম মেয়াদে টেস্ট ক্রিকেটে দেশের বাইরে লঙ্কান এই কোচের এটাই ছিল একমাত্র সাফল্য। 

২০১৬ সালে ঘরের মাঠে স্পিন উইকেটে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও একই পথ অবলম্বন করে নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ড। সেখানেও সফল হাথুরুসিংহে-পাপনরা। মেহেদী হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসান মিলে টেস্টে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়াকে ধ্বসিয়ে দেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তাইজুল-মিরাজ-সাকিব মিলে বাংলাদেশকে ২০ রানের জয় উপহার দেন মিরপুরে। 

ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশ যায় নিউজিল্যান্ডে। তাসমান পাড়ের সেই দেশের বৈরি কন্ডিশনে তিন ফরম্যাটেই ভরাডুবি হয় চন্ডিকার শিষ্যদের। সেখানে স্পোর্টিং উইকেটে ব্যক্তিগত অর্জন থাকলেও দলগত সাফল্যে মোটাদাগে ব্যর্থ হন সাকিব-তামিমরা।

ব্যক্তিগত অর্জনে সাকিব হাকান দ্বিশতক (২১৭), অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে আসে দেড়শো (১৫৯) রানের দারুণ এক ইনিংস। 

এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন লঙ্কান এই কোচ। সেখানে দুই টেস্টের চার ইনিংসে একবার তিনশো পার হয় বাংলাদেশ। যেখানে এক ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ৯০ রানে। বাকী দুই ইনিংসে দেড়শো পার হলেও দুইশোর ঘর ছুতে পারেনি টাইগাররা। সেই সফরে টেস্টের মতো ওয়ানডে ও টি২০তেও ছিল একই ভুলের পুনরাবৃত্তি। 

এমন দুঃসহ এক সিরিজের পর বাংলাদেশ ফেরার সাহস দেখাননি লঙ্কান এই কোচ। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের কোনো প্রতিবেদন না দিয়েই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরে অবশ্যই পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা সারতে এসেছিলেন বাংলাদেশে।  

হাথুরুসিংহে বিদায়ের পর গ্যারি কার্স্টেনের পরামর্শে প্রধান কোচ হিসেবে ইংল্যান্ডের স্টিভ রোডসকে নিয়োগ দেয় বিসিবি। রোডসের অধীনে বাংলাদেশ প্রথম বিদেশ সফরে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যায়। সেখানে টেস্টে ভরাডুবি হলেও ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজ জিতে ফিরে বাংলাদেশ। 

হাথুরুসিংহে মন্ত্রে এতোটাই আচ্ছন্ন ছিল নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ড, রোডসের অধীনে ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের বিপক্ষেও স্পোর্টিং উইকেটে খেলার সাহস দেখাতে পারেনি হারের ভয়ে! তাই ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টও পাপনের বোর্ড খেলে স্পিন উইকেটে, ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল। স্পিন শক্তিমত্তায় টাইগারদের চেয়ে আফগানরা ঢের এগিয়ে, সেটাই প্রমাণিত হয় ক্রিকেটের বাইশগজে। নিজেদের পছন্দসই স্পিন উইকেটে খেলা বলে একাদশে এক পেসার রেখেছিল সাকিবের দল। বাংলাদেশের স্পিন সামলিয়ে আসগর আফগান (৯০) ও রহমত শাহ (১০২) সেঞ্চুরি তুলে নিলেও তামিম-লিটনরা ছিলেন পুরোদমে ব্যর্থ। তাই ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে প্রথম দেখায় সাকিব-মুশফিকদের হেসেখেলেই ২২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে দেয় রাশিদ-মুজিবরা। 

সেসময় একাদশে এক পেসার রাখা প্রসঙ্গে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন,  ‘যখনই খেলা হয়, মাশরাফি বলে আমি চারজন পেসার নিয়ে খেলব। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে তিনজন পেসার দেওয়া হয়। ও বলবে পেসাররাই আমাদের সব ম্যাচ জেতায়। আবার সাকিবকে জিজ্ঞাস করেন। সাকিব বলবে সব স্পিনার নিয়ে খেলব, স্পিনাররাই তো জেতায়।’

২০১৯ বিশ্বকাপের ব্যর্থ বাংলাদেশের কোচ হিসেবে রোডস অধ্যায় অতোটা দীর্ঘ হয়নি। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায়ে রোডসকে বরখাস্ত করে বিসিবি। সেই বিশ্বকাপের কিছুদিন পর ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করায় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিব আল হাসানকে নিষিদ্ধ করে আইসিসি।

রোডসের বিদায়ের পর নতুন কোচ হিসেবে বিসিবি নিয়োগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকান রাসেল ডমিঙ্গোকে। আর টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের স্থলাভিষিক্ত করা হয় মুমিনুল হককে। ডোমিঙ্গো-মুমিনুল জুটি স্পিন নির্ভরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা চালান। তবে ঘরের মাঠে স্পিন সহায়ক উইকেটে সহজে জয় তুলে নেওয়ার কৌশল থেকে এতো তাড়াতাড়ি বের হতে চায়নি বিসিবি। তাই ঘরের মাঠে স্পিনেই সফরকারীদের ঘায়েল করায় ব্যস্ত থাকতেন পাপন-নান্নুরা। 

বিশেষ করে বিদেশ সফরের ভরাডুবি ঢাকতেই এই কৌশল অবলম্বন করত বিসিবি। যেকোনো দেশে সফরে গেলেই জয়ের চেয়ে পরাজয়ের পাল্লাই ভারি থাকত বাংলাদেশের। ২০২১ সালে দেশের মাটিতে স্পিন উইকেটে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ সিরিজ জিতেও সে বছর টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে চরম ব্যর্থ হয়েছিল বাংলাদেশ।

তবে মুমিনুল-ডোমিঙ্গো যুগে বাংলাদেশের টেস্ট দলে পেস বিল্পবের শুরু। তিন পেসার খেলাতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে মুমিনুলকে। শুরুতে এতো সাফল্য না পেলেও, সেরা সাফল্য মুমিনুল পান নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে। ২০২২ সালে এবাদত হোসেনের অবিস্মরণীয় বোলিংয়ে তাসমান পাড়ে মমিনুলরা নিউজিল্যান্ডকে উড়িয়ে ছিনিয়ে আনে ৮ উইকেটের বড় জয়। সেই থেকেই বাংলাদেশের একাদশে পেস বিল্পবের শুরু। বিদেশে খেলা মানে একাদশে পেসারদের আধিক্য। ডোমিঙ্গোর অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাগতিকদের ওয়ানডে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ। সেখানেও ছিল পেসারদের দাপট। 

২০২৩ বিশ্বকাপের মাস তিনেক আগে হুট করেই ডোমিঙ্গোকে হটিয়ে হাথুরুসিংহেকে দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় বিসিবি। তার অধীনে ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ চরম ব্যর্থতার মুখে পড়ে টাইগাররা। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হার। বিশ্বকাপে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠার রসদ হাথুরুসিংহে ও নাজমুল হোসেন শান্তরা পান নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে। সিলেটে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে তাইজুলের স্পিন জাদুতে কিউইদের ১৫০ রানের বিশাল ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। 

ম্যাচে সিলেটের উইকেটে সবুজ ঘাস দেখে অনেকে ভেবেছিলেন, বাংলাদেশে বুঝি এবার পেস বোলারদের রাজত্ব দেখা যাবে। তবে সেই সবুজ ঘাসে মোড়ানো উইকেটে ছিল কিছুটা ব্যাটারদের সুবিধা আর বাকীটা ছিল স্পিনারদের দখলে। আর সেটা প্রতীয়মাণ হয়েছিল তাইজুলের স্পিন জাদুতে। সেদিন ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত খেলেই নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে অবশ্য পুরোনো রুপে ফিরে যায় শান্ত-মুমিনুলরা, সেই ম্যাচ নিউজিল্যান্ডের কাছে ৪ উইকেটে হেরেছিল স্বাগতিকরা। টেস্ট সিরিজ ড্র হলেও ওয়ানডে বাজেভাবে হারে বাংলাদেশ। এখানেও ছিল ব্যাটারদের পারফরম্যান্স ছিল চরম হতাশাজনক।

বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্স, ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে হার৷ এমন বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নির্বাচক প্যানেলে পরিবর্তন আনে বিসিবি। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে সরিয়ে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব দেওয়া হয় গাজী আশরাফ হোসেন লিপুকে। হাবিবুল বাশার সুমনের জায়গায় যুক্ত হন হান্নান সরকার। 

নতুন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে গড়া দল নিয়ে বাংলাদেশ প্রথম খেলতে নামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।  ঘরের মাঠে লঙ্কানদের বিপক্ষে  ওয়ানডে সিরিজ জিতলেও টেস্টে হোয়াইটওয়াশ ও টি২০ সিরিজ ২-১ ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। এই সিরিজ অবশ্যই বিন্দুমাত্র উইকেটের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেনি বাংলাদেশ। স্পোর্টিং উইকেটে খেলে নিজেদের শক্তিমত্তা পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা খায় হাথুরুসিংহের শিষ্যরা।

লঙ্কানদের বিপক্ষে এমন ফলাফলে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের টেস্ট পারফরম্যান্স নিয়ে প্রধান নির্বাচক লিপু বলেছিলেন, ‘টেস্ট ম্যাচ ক্রিকেটে দলের পারফরম্যান্স নিয়ে আমরা হতাশ। আমাদের আশা ছিল যে, দল আরও ভাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ফলাফল যে আমাদের পক্ষে আসতে হবে এমন কোনো কথা ছিল না। আগেই বলেছি যে, যথেষ্ট স্পোর্টিং উইকেটে খেলার চেষ্টা করেছি। কারণ আমাদের দেশের পাশাপাশি বাইরের দেশে গিয়েও খেলতে হবে। সেটার জন্য নিজেদের সক্ষমতা, দূর্বলতা বিচার করার জন্য বিসিবি এই ধরণের ভেন্যু, উইকেটের ব্যবস্থা করেছে। এতে হয়তো আমরা কিছুটা আশাহত কিন্তু আমাদের দূর্বলতার জায়গাগুলো ফুটে উঠেছে।’

স্পোর্টিং উইকেটে খেলে নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টায় সফল বিসিবি। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট হারলেও পাকিস্তানে গিয়ে সিরিজ জিতে এসেছে খুব সহজে। সেখানে স্পোর্টিং উইকেটে পেসারদের দাপটে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়েছে ২-০ তে। পেসারদের দাপটে সিরিজ জিতলেও বাংলাদেশকে হতাশ করেছে ব্যাটিং। লিটন-মিরাজ ছাড়া সাদমানের ব্যাটে রানের দেখা মিললেও বাকীদের ব্যাট ছিল নিষ্প্রভ। আর সেই ধারাবাহিকতা ছিল ভারত সিরিজেও, সেখানে পেসাররা দাপট দেখালেও ব্যাটারদের ব্যর্থতায় কোনো রকম লড়াই ছাড়া ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে হাথুরুসিংহের শিষ্যরা। 

ভারত সিরিজ শেষে ২০২৩ বিশ্বকাপে ক্রিকেটার গায়ে হাত তোলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিসিবি বরখাস্ত করে কোচ হাথুরুসিংহেকে। তার জায়গায় নিয়োগ পান ফিল সিমন্স।

ভারত সিরিজের ব্যর্থতা ঢাকতে পুরোনো পথেই হাটছে ফারুক-সিমন্স জুটি। ফারুক সভাপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম ঘরের মাঠে টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। প্রধান কোচ হিসেবে সিমন্সেরও এটা প্রথম সিরিজ। সভাপতি-কোচ নতুন হলেও বাংলাদেশের হাঁটছে সেই পুরোনো নীতি মেনেই। পাপন-হাথুরুসিংহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘরের মাঠে নিজেদের প্রথম টেস্টেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক পেসার নিয়ে একাদশ সাজিয়েছেন ফারুক-সিমন্সরা। 

ফারুক-সিমন্সে লক্ষ্য সেই আগের মতোই বিদেশ সফরের ব্যর্থতা ঢাকতে নিজেদের কন্ডিশন কাজে লাগিয়ে জয় তুলে নেওয়াই তাদের লক্ষ্য ছিল কিনা কে জানে। ভারতের বিপক্ষে হারের পর এবার ঘরের মাঠে হারলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠবে সমালোচনার ঝড়৷ স্পিন উইকেটে বানিয়েও যদি দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটা ম্যাচে কাবু করা যায় তাই হয়তো একাদশে তিন স্পিনারের বিপরীতে এক পেসার রাখা। 

বোলাররা কন্ডিশন কাজে লাগালেও, স্বাগতিক ব্যাটাররা হয়েছেন ব্যর্থ। ব্যাটারদের অসহায় আত্মসমর্পনে বাংলাদেশ থেমেছে মাত্র ১০৬ রানে। জবাবে প্রথম ইনিংসে কাইল ভেরেইনা (১১৪) সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকা করেছে ৩০৮ রান। 

স্পিন সহায়ক উইকেটেও এক তাইজুল ইসলাম ছাড়া মিরপুরে স্বাগতিকদের অন্য স্পিনাররা আফ্রিকান ব্যাটারদের চাপে ফেলতে পারেননি। তাই মিরপুরের স্পিন বান্ধব পিচেও প্রোটিয়ারা ২০২ লিড তুলে নেয় অনায়সে। 

তবে এবার এক পেসার নিয়ে খেলার দায়টা অবশ্যই কোচের কম, দল নিয়ে মাঠে নামার আগে কাজ করার তেমন সুযোগ ছিল না সিমন্সের সামনে। তাই অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর কথাই শুনতে হয়েছে তাকে। অধিনায়কের কথায় এক পেসার খেলিয়েছেন সিমন্স। টেস্ট শুরুর আগে নাজমুল হোসেন শান্ত জানিয়েছিলেন, 'নতুন কোচ এসেছেন। খুব একটা কাজ করার সুযোগ পাননি। আমিই পরিকল্পনা শেয়ার করেছিলাম, কোচ পছন্দ করেছেন।'

নিজেদের কন্ডিশনে স্পিন সহায়ক বাংলাদেশের স্পিনারদের এমন বিবর্ণ পারফরম্যান্স কারণে রয়েছে বোলিংয়ে বৈচিত্রতার অভাব। মানের দিক থেকে বাংলাদেশের স্পিনাররা পিছিয়ে, যেখানে এগিয়ে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ান স্পিনাররা। সংখ্যায় কমও হলেও তাদের সাফল্য অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়ার নাথান লায়নের কথাই ধরুন, বিশ্বের যেকোনো কন্ডিশনেই তিনিই সেরা। এদিক থেকে বাংলাদেশে আছেন কেবল সাকিব আল হাসান। যাকে স্পিনার হিসেবেও যেকোনো কন্ডিশনে খেলোনোর দুঃসাহস দেখাতে পারত ম্যানেজমেন্ট।  

বাংলাদেশী স্পিনারদের বৈচিত্রতার অভাবের পিছনে টি২০ ক্রিকেটকেই দায়ী করেন সিলেট বিভাগীয় দলের ম্যানেজার আলী ওয়াসিকুজ্জামান অনি। সিলেটে এনামুল হক জুনিয়রের পর স্পিনার হিসেবে জাতীয় দলে নাসুম আহমেদ। তাও এনামুলের অভিষেকের দেড় যুগ পরে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে এটা ভিন্ন। এখন ক্রিকেটটা হয়ে গেছে টি২০ নির্ভর। ক্লাব ক্রিকেটটা কঠিন হয়ে গেছে। এখন স্পিনাররা রান আটকানোর জন্য সোজা এবং আর্ম বল করে থাকে৷ কোচ স্পিনারকে বলে দিচ্ছে, ‘রান আটকানোর জন্য বোলিং করো।’ সে টার্নের দিকে মনোযোগী হয় না, তার লক্ষ্যই থাকে রান আটকানো। এদিক থেকে আমরা নেতিবাচক ক্রিকেটই খেলছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভিন্ন একটা জায়গা, এখানে বোলিং ভেরিয়েশন থাকাটা জরুরি। এরজন্য আপনি দেখবেন বাংলাদেশে যখন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া আসে, তারা তখন এক দুইটা  স্পিনার নিয়েই চলে আসে। অস্ট্রেলিয়া আসলে নাথান লায়নকে নিয়ে আসবে। তখন দেখা যাবে যে, লায়ন একাই আমাদের হারিয়ে দিচ্ছে। কারণ সে প্রোপার স্পিনার, বোলিংয়ে ভেরিয়েশন আছে, টার্ন আছে। বৈরি কন্ডিশনে  যা আমাদের স্পিনারদের মধ্যে দেখা যায় না। ফলে আমাদের ব্যাটাররাও এটা বুঝতে পারে না। কারণ আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটটা সঠিকভাবে খেলছি না। এখানে বোলিংয়ে বৈচিত্রতা আনার চেয়ে রান আটকানোতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যার ধরুন, সিলেট তথা বাংলাদেশেও গুণগত মান সম্পন্ন স্পিনার বের হচ্ছে না।’ 

তাই এভাবে স্পিন নির্ভর উইকেটে খেলতে থাকলে বড় পরিসরে কোনো সাফল্য ধরা দিবে না। নিজেদের মাঠে বড় দলগুলোর বিপক্ষে এক দুই ম্যাচ জয়েই সন্তুষ্টের ঢেকুর তুলতে হবে। আর বিশ্ব আসরে গিয়ে ফিরতে হবে শুন্য হাতে৷ যেমনটা বিগত বছর গুলোতে পরিলক্ষিত হয়েছে, বিশ্বমঞ্চে এখনও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। 

দেশে কিংবা বিদেশে ক্রিকেটে সাফল্য পেতে হলে ফারুক-সিমন্স জুটিকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলার সাহস দেখাতে হবে। নতুবা স্পিন-পেস এ ভাল করলেও দুর্বলতা থেকে যাবে ব্যাটিংয়ে। এমন উইকেটে খেলে ব্যাটারদের উন্নতি করা সম্ভব না।

যেমনটা ২০২১ সালে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পরও সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, ‘'এ রকম উইকেটে কোনো ব্যাটসম্যান ১০-১৫টা ম্যাচ খেললে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। এটা কাউন্ট না করি আমরা।’

Details Bottom