টেস্ট ওপেনিংয়ের অভিশাপ কাটানোর পথে জয়

৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল

প্রকাশ: 4 ঘন্টা আগে আপডেট: 53 সেকেন্ড আগে
টেস্ট ওপেনিংয়ের অভিশাপ কাটানোর পথে জয়

টেস্ট ওপেনিংয়ের অভিশাপ কাটানোর পথে জয়

টেস্ট ওপেনিংয়ের অভিশাপ কাটানোর পথে জয়

বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ওপেনিং পজিশন দীর্ঘদিন ধরেই এক অনন্ত পরীক্ষার মঞ্চ। প্রায় এক যুগ ধরে প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেছে। এক প্রান্তে তামিম ইকবাল ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক, আর অন্য প্রান্তে নতুন মুখের অবিরাম আগমন ও প্রস্থান। ধারাবাহিকতা না পাওয়ায় বিসিবির নির্বাচকেরা বারবার ঘরোয়া ক্রিকেটের দরজায় কড়া নড়েছেন, কিন্তু স্থায়ী সমাধান যেন আসেনি। ইমরুল কায়েস একসময় একটু আশার আলো দেখালেও শেষ পর্যন্ত তিনিও হারিয়ে যান সেই অধারাবাহিকতার অন্ধকারে। জুনাইদ সিদ্দিকী, এনামুল হক বিজয় কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে শান্ত বা সাদমান, কারো হাত ধরেই পুরোপুরি মুক্তি মেলেনি ওপেনিং সংকটের।


এই ব্যর্থতার মাঝেই বিসিবির নির্বাচকেরা নতুন এক কৌশল নেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে যারা ভালো করছেন, তাদের মধ্যে থেকে ওপেনার তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সমস্যাটা থেকে যায় অন্য জায়গায়। এদের বেশিরভাগই মূলত তিন কিংবা চার নম্বরে ব্যাট করতে অভ্যস্ত। নতুন বলের চ্যালেঞ্জ সামলানোর জন্য যে মানসিক ও টেকনিক্যাল প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা এই ব্যাটারদের কারও মধ্যেই পুরোপুরি তৈরি ছিল না। যার বড় উদাহরণ লিটন দাস। টি-টোয়েন্টিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে ওপেনিং করলেও টেস্টে কিংবা ওয়ানডেতে চার বা পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতেই পছন্দ করেন। কারণ ওপেনিং মানে শুধু ব্যাটিং অর্ডারে উপরে নামা নয়, বরং এটি এক ভিন্ন ধরণের মানসিক দৃঢ়তা ও টেকনিক্যাল পরীক্ষার জায়গা।


এই বাস্তবতার মাঝেই উঠে আসে মাহমুদুল হাসান জয়ের গল্প। জয় মূলত যুব দলে ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিন নম্বর ব্যাটার হিসেবে দাপট দেখিয়ে টেস্ট দলে ডাক পান। ২০২০ যুব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনে নেমে সেঞ্চুরি করে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও তিন নম্বরেই ছিলেন তার ঘাঁটি। ১৯৫ বলে ১১২, তারপর ২১১ বলে ১২১ এবং শেষদিকে ৮৩ রানের ইনিংস খেলে নিজের জায়গা আরও মজবুত করেন। নয় ইনিংসের মধ্যে আটবারই তিন নম্বরে ব্যাট করেছিলেন তিনি।


কিন্তু টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার পরই তাকে ওপেনিংয়ে নামানো হয়। সেখানেই যেন শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একমাত্র সেঞ্চুরিটি বাদ দিলে বাকি ম্যাচগুলোতে জয়কে দেখা যায় নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। জাতীয় দলের বাইরে গিয়ে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন ওপেনার হিসেবেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে, বিশেষ করে সর্বশেষ জাতীয় ক্রিকেট লিগ টি-টোয়েন্টিতে, তিনি অসাধারণ ধারাবাহিকতা দেখান।


সিলেটের বিপক্ষে ৬৩ বলে ১১০ রানের ইনিংসে নয় ছক্কা ও পাঁচ বাউন্ডারিতে জয় নিজের ব্যাটে ফেরান আত্মবিশ্বাস। পুরো টুর্নামেন্টে তিনি প্রায় ৪৭ গড়ে ৩২৩ রান করেন, যা ছিল ঘরোয়া পর্যায়ে সবচেয়ে আলোচিত পারফরম্যান্সগুলোর একটি। চারদিনের ম্যাচেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। রাজশাহীর বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১২৭ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫১ রান করেন তিনি। বরিশালের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে করেন ৩৫ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ২৫। এই ধারাবাহিক পারফরম্যান্সই তাকে আবারও ফিরিয়ে আনে জাতীয় দলে।


প্রায় আট মাস পর জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামেন জয়। ভাগ্যের পরিহাস, সেই সিলেটেই তার প্রত্যাবর্তন যেখানে আগেরবার বাদ পড়েছিলেন টেস্ট দল থেকে। এবার তবে গল্পটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট হাতে খেলেন রাজকীয় ইনিংস। দিনের শেষে অপরাজিত ১৬৯ রানে জয় থামেননি, বরং বাংলাদেশের স্কোর তোলেন ৩৩৮ রানে এক উইকেটে। সাদমান ইসলামের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটিতে আসে ১৬৮ রান। এরপর তিনে নামা মমিনুল হকের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ১৭০ রানের পার্টনারশিপে দিন শেষ করেন জয়।


২৮৩ বল খেলে ১৬৯ রানের ইনিংসটি সাজিয়েছেন ১৪টি চার ও চারটি ছক্কায়। একদিকে ধৈর্য, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন—এই দুইয়ের মিশেলে জয় যেন ওপেনিংয়ের কঠিন বাস্তবতায় নিজেকে নতুনভাবে প্রমাণ করলেন।


বাংলাদেশের টেস্ট ওপেনিং এখনও সবচেয়ে কঠিন পজিশনগুলোর একটি। নতুন বলে সুইং, মুভমেন্ট, আর প্রতিপক্ষ পেসারদের ভয়ংকর স্পেল সামলে টিকে থাকার কাজটা সহজ নয়। কিন্তু মাহমুদুল হাসান জয় দেখিয়ে দিয়েছেন, ধৈর্য ও মানসিক দৃঢ়তা থাকলে এই জায়গাতেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক রান করে জাতীয় দলে ফিরে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। এখন দরকার শুধু ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।


বাংলাদেশের ওপেনিংয়ের যে অন্ধকার যুগ অনেকদিন ধরে চলেছে, সেখানে মাহমুদুল হাসান জয়ের এই প্রত্যাবর্তন হয়তো নতুন আলো দেখাচ্ছে। সেই আলো কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা সময়ই বলবে। তবে আপাতত বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নির্ভরতার জায়গা খুঁজে পাওয়ার আশা জেগে উঠেছে।