Image

বিসিবি নির্বাচন: মাঠের মানুষ বনাম প্রশাসনের ‘সিলেকশন’

৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল

প্রকাশ: 7 ঘন্টা আগেআপডেট: 16 মিনিট আগে
বিসিবি নির্বাচন: মাঠের মানুষ বনাম প্রশাসনের ‘সিলেকশন’

বিসিবি নির্বাচন: মাঠের মানুষ বনাম প্রশাসনের ‘সিলেকশন’

বিসিবি নির্বাচন: মাঠের মানুষ বনাম প্রশাসনের ‘সিলেকশন’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আসন্ন নির্বাচন ঘিরে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকটাই দেশের রাজনীতির একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। নির্বাচন যত এগোচ্ছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে এটি কেবল নেতৃত্ব নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি ক্রীড়া প্রশাসনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তির একটি পরীক্ষার মঞ্চ। নির্বাচনী মাঠে একদিকে রয়েছেন বিসিবির দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞ প্যানেল, যাদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, অন্যদিকে রয়েছেন সদ্য অবসর নেওয়া সফলতম ওপেনার তামিম ইকবাল, যিনি ‘মাঠের মানুষ’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছেন।


এই নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় উপদেষ্টা বলেন, তিনি যাদের একসময় প্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে দেখতেন, তারা এখন এমন কিছু কর্মকাণ্ডে জড়িত, যা তাকে ‘শক’ করেছে এবং যা তিনি ‘লজ্জাজনক’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। যদিও কোনো নাম সরাসরি উচ্চারণ করা হয়নি, ক্রীড়াঙ্গনে বেশিরভাগের ধারণা, এই মন্তব্যের ইঙ্গিত সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালের দিকেই। অতীতে যাকে তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন, তার দিকেই এখন এমন ঘুরে যাওয়া বক্তব্য কেবল ব্যক্তিগত হতাশা নয়, বরং বড় ধরনের অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
তবে কেবল মন্তব্যেই শেষ হয়নি বিষয়টি। ক্রীড়া উপদেষ্টা এক পর্যায়ে নিজেই স্বীকার করেছেন যে, বিভিন্ন জেলা প্রশাসকদের ওপর ফোন করে কাউন্সিলর মনোনয়নের বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। 


যদিও তিনি দাবি করেন, সরকারের হস্তক্ষেপ কেবল নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু’ করতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন একটি ছবি তুলে ধরছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে যেভাবে নিয়ম ভাঙা হয়েছে এবং সময়সীমা নিয়ে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়েও।


এই প্রেক্ষাপটে রোববার একটি সংবাদ সম্মেলনে মুখ খোলেন তামিম ইকবাল। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার নানা অসঙ্গতি ও অনিয়ম। তিনি জানান, ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তিনি কেবল একটি কথাই বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন চান।’ তিনি কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা সুবিধা চাননি। কিন্তু বাস্তব চিত্র তার বিপরীত। জেলা, বিভাগ, এমনকি ক্লাব পর্যায়েও নির্বাচনকে ঘিরে যে অস্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে, তা স্পষ্টতই কোনো উন্মুক্ত নির্বাচনের আলামত দেয় না।


তামিম আরও অভিযোগ করেন, ১৬ তারিখের পর সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রথমবারে কিছু ডিরেক্টরের সম্মতিতে নেওয়া হলেও দ্বিতীয়বার সেই সিদ্ধান্ত এককভাবে বিসিবি সভাপতি নিয়েছেন, এবং সে সিদ্ধান্তের সঙ্গে আর কাউকে জড়ানো হয়নি। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কমিশনের দায়িত্ব হলেও, সভাপতি নিজে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর মতে, এটি নিয়মের পরিপন্থী এবং নির্বাচনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ব্যাহত করে।


সংবাদ সম্মেলনে সবচেয়ে বিস্ফোরক মন্তব্যটি ছিল, “এটি নির্বাচন নয়, এটি সিলেকশন হয়ে যাচ্ছে।” এ কথাটি কেবল ক্ষোভ থেকে বলা একটি উক্তি নয়, বরং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা হারানোর বহিঃপ্রকাশ। একজন সাবেক অধিনায়কের মুখে যখন এমন কথা উঠে আসে, তখন সেটি গোটা প্রক্রিয়ার ওপরই প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে। এই বক্তব্যের পেছনে রয়েছে তার পর্যবেক্ষণ, নীরব চাপ এবং নীতিগত অবস্থান।


উল্লেখযোগ্যভাবে, এই নির্বাচন ঘিরে ‘সরকারি প্রার্থী’ এবং ‘বিরোধী প্রার্থী’ ট্যাগিংও ঘটেছে, যা রাজনৈতিক রঙকে আরও ঘন করে তুলেছে। যদিও তামিম ইকবাল বা কোনো রাজনৈতিক দল থেকে সরাসরি এমন কোনো অবস্থান নেওয়া হয়নি, তথাপি তাঁকে ‘বিএনপির প্রার্থী’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে, যা নির্বাচনের পবিত্রতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একজন সাবেক ক্রিকেটার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই যদি রাজনৈতিক পরিচয় জুড়ে দেওয়া হয়, তবে সেটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা।


এই মুহূর্তে বিসিবি নির্বাচন কেবল একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হিসেবে থাকছে না। এটি হয়ে উঠেছে ন্যায়পরায়ণতা বনাম কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব, যেখানে প্রশ্ন উঠছে, ক্রিকেটের প্রশাসন কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবে? মাঠের মানুষদের জন্য প্রশাসনের দরজা কি খোলা থাকবে, নাকি সেটি চিরতরে ‘নির্বাচিত’ গোষ্ঠীর জন্যই বরাদ্দ থাকবে?

তামিম ইকবালের অবস্থান এবং বক্তব্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছে। তিনি নির্বাচনকে ‘সিলেকশন’ বলার মাধ্যমে সবার সামনে একটি আয়না ধরে রেখেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ, সভাপতি নিয়মের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এবং ক্রীড়া উপদেষ্টা পক্ষপাতমূলক অবস্থান নিচ্ছেন। এই চিত্র শুধু তামিমের জন্য নয়, ভবিষ্যতে যেকোনো প্রার্থী, বিশেষ করে মাঠ থেকে উঠে আসা যেকোনো ক্রীড়াবিদের জন্য হতাশাজনক বার্তা বহন করে।


এখন প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট কি কেবল মাঠেই লড়বে, নাকি মাঠের বাইরেও তার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে? নির্বাচনের ফলাফলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনের প্রক্রিয়া। একটি প্রক্রিয়া যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তবে তার ফলাফল যতই গ্রহণযোগ্য হোক, আস্থার সংকট থেকেই যাবে।


একজন সাবেক অধিনায়ক যখন নির্বাচন কমিশনের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মুখ খোলেন, তখন সেটি আর কেবল ‘একজন প্রার্থীর অভিযোগ’ থাকে না। তা হয়ে দাঁড়ায় একটি ব্যবস্থা নিয়ে বৃহৎ প্রশ্ন। এখন সময়, ক্রীড়া প্রশাসনের ভিত কতটা গণতান্ত্রিক, তা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে পর্যালোচনা করার।


বাংলাদেশ ক্রিকেট শুধু গৌরবের ইতিহাস নয়, এটি জাতীয় গর্বের অংশ। সেই ক্রিকেটের নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে নির্বাচন নামের একটি গোপন প্রক্রিয়ায়, যেখানে নির্বাচনের বদলে চলছে ‘সিলেকশন’? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া এখন সময়ের দাবি।
 

Details Bottom
Details ad One
Details Two
Details Three