ভারতকে উড়িয়ে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার হেক্সা

অস্ট্রেলিয়া 4
Vinkmag ad

ষষ্ঠ-বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতল অস্ট্রেলিয়া। দলটির চাহিদা ও অর্জনের এত চমৎকার মিশেল, যা আর কোনো ক্রিকেট দল খুব কমই দেখাতে পেরেছে। আজ প্রথমে ব্যাট করতে নামা স্বাগতিক ভারত পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলে ২৪০ রানে গুটিয়ে যায়। জবাবে ব্যাট করতে নেমে, শুরুর চাপ কাটিয়ে ৪২ বল বাকি থাকতেই ফাইনালের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে সত্যি করে অস্ট্রেলিয়া।

আহমেদাবাদে টস খুব একটা বড় কথা নয়। এমনটা জানা গিয়েছিল গতকাল সংবাদ সম্মেলনেও। আজ টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামা ভারত কোহলি ও রাহুলের হাফ-সেঞ্চুরি পেরোনো ইনিংসের উপর ভর করে ২৪০ রান সংগ্রহ করে। যেখানে স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজেলউড; এই পেস-ত্রয়ী মিলে লুফে নেয় ৭ টি উইকেট।

সহজ লক্ষ্যমাত্রা হলেও, শুরুতে তা সহজ ছিল না অস্ট্রেলিয়ার জন্য। দলীয় ৪৭ রানে পড়ে ৩ উইকেট। সেখান থেকে হেড ও লাবুশেইন এর অভাবনীয় ১৯২ রানের জুটিতে পথ সহজ হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য। হেডের ব্যাটে আসে কাঙ্ক্ষিত শতক। ৪৩ ওভারেই মহাগুরুত্বপূর্ণ ফাইনালে জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

ধারণা করা হচ্ছিল, দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম ১০ ওভার গড়ে দিবে ম্যাচের ভাগ্য। সেখানে ভারতকে পাশ মার্ক দিতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ৬০ রান তুলেছে বটে, একইসাথে ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেটও হারিয়েছে। বুমরাহ ও শামি’র বলগুলি চাবুকের মতো ধেয়ে আসছিল অজিদের ব্যাটে। যা সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল ব্যাটারদের জন্য।

প্রথম ওভারে উড়ন্ত শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, ১৬ রান। পরের ওভারে মোহাম্মদ শামির প্রথম বলেই ওয়ার্নারের পতন। গুড লেন্থ বল এজ হয়ে কোহলির বিশ্বস্ত হাতে গিয়ে পড়ে। দারুণ এক ক্যাচ নিয়ে ডেভিড ওয়ার্নারকে বিদায় করে আকাশি-নীল দল।

টুকটাক করে হেড ও মার্শ মিলে পেস সামলানোর চেষ্টা করতে থাকেন। হেড সুযোগ বুঝে খেলছিলেন। তবে মিচেল মার্শ নিজের সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে পারেননি। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালানোর ‘বদঅভ্যাস’ পেয়ে বসেছিল। আর তাতেই জীবন গেল।

অস্ট্রেলিয়ার দলীয় সংগ্রহ তখন ৪১ রানে ২ উইকেট।

পরের উইকেটটিও পড়তে যে সময় নেয়নি। স্টিভ স্মিথ ভুলই করে বসলেন। ভারতের পেসারদের চাপ পেয়ে বসেছিল কিনা, কে জানে! বুমরাহ লেগ বিফোরের আবেদন করে বসেছেন, আম্পায়ারও আঙ্গুল তুললেন।

স্মিথ চার রান সঙ্গে করে, রিভিউ না নিয়ে বিদায় নিলেন। পরে দেখা গেল ‘ইম্প্যাক্ট আউটসাইড অফ’, একেবারেই বিধিসম্মত ‘নট আউট’, রিভিউ নিলেই বেঁচে যেতে পারতেন তিনি।

এভাবে উইকেট হারিয়ে বসে তখন বেশ চাপে হলুদ জার্সি পরিহিত দল। আর এদিকে স্বাগতিকদের উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনায় গ্যালারি যেন ভেঙে পড়ছে আহমেদাবাদে।

ক্রিজে এলেন নতুন ব্যাটার মারনাস লাবুশেইন। হেড তখন একা সৈনিক হিসেবে মাঠে রয়েছেন। লাবুশেইনকে সাথে নিয়ে হেডের যুদ্ধংদেহি লড়াই চলতে থাকল।

লাবুশেইন দেখে শুনে, দৌড়িয়ে খেলছিলেন। আর ওদিকে হেড নিজের মতো। কখনো একটা কাভার বা পুল সীমানার দিকে ছুটে যায়। আর দর্শকরাও কেমন চুপসে যাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ার রান শতক ছাড়িয়ে যায়।

হেড নিজের অর্ধশতক পূরণ করেন। রানের চাকা ছুটে চলছিল। যেন আর কোনো বাঁধা নেই। শুরুর ভয় কেটে, আত্মবিশ্বাস পেয়ে বসেছে অস্ট্রেলিয়াকে। শত রানের জুটি করতেও সময় লাগেনি এই দুই ব্যাটারের।

দলীয় ১৫০ যেমন একদিকে। অন্যদিকে হেড শতকের কাছাকাছি চলে যায় তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। এই ওপেনার শতকটা করে নেন ৯৫ বলে। তখন যেন আর কিছুই বাকি নেই ভারতের জন্য।

কোনো বোলার বদলেও কোনো ফায়দা তোলা যাচ্ছে না। বুমরাহ-শামি-কুলদীপ কিংবা জাদেজা ‘ব্রেকথ্রু’ নেওয়ার চেষ্টা করলেন কত-জন! আসেনি কোনো ফলাফল।

ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে ওদিকে দীর্ঘ সময় ক্রিজে কাটিয়েছেন লাবুশেইন। অর্ধশতকটা তুলেছেন ৯৯ বল খেলে।

বাকি পথটুকু খুব সহজেই পাড়ি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কোনো বাঁধা ছাড়া, নির্ঝঞ্ঝাট এক আরামের ছোট পথটুকু…আনন্দ যেন বাঁধ ভেঙে আসছিল ক্রিজে থাকা হেড ও লাবুশেইন এর মন জুড়ে। একইসাথে পুরো অস্ট্রেলিয়ারও।

শেষপর্যন্ত জয় তুলে নেওয়া ম্যাচে, হেড জিততে যাওয়া দুই রান বাকি থাকতে নিজের উইকেট হারিয়েছেন বড় শট খেলতে গিয়ে। ইনিংসে ৪ টি ছয় ও ১৫ টি চারে ১২০ বলে ১৩৭ রান সংগ্রহ করেন।

নতুন ব্যাটার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এসে দৌড়ে বাকি দুই রান তুলে নেন। অন্যদিকে লাবুশেইন অপরাজিত ছিলেন ১১০ বল খেলে ৫৮ রানে।

এর আগে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে টস জেতার সিদ্ধান্ত নিয়ে যতটা না নেতিবাচক আলোচনা ম্যাচ শুরুর সময়, তারচেয়ে বেশি প্রশংসা ভেসে এসেছে ম্যাচ শুরু হওয়ার পরেই। কামিন্সকে বাহবা দিয়েছেন সবাই। তা অবশ্য শুধুই টস জেতার জন্য এমনও নয়। স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজেলউড মিলে ভারতীয় ব্যাটারদের যে হারে ভুগিয়েছেন, বাহবার অংশ ছিল সেসবও।

রোহিতের মারমুখী ব্যাটে আজও সুদে-আসলে রান উঠিয়েছে ভারত। পাওয়ারপ্লেতে আসা ৮০ রানের বিপরীতে হারিয়েছে ২ উইকেট।

মিচেল স্টার্কের শর্ট অব লেন্থ বলে পুল খেলতে যাওয়াটা যে উচিত কিছু হয়নি, তা শুবমান গিল বুঝেছেন উইকেট হারানোর পর। ৭ বলে ৪ করে ফেরা, যে গল্প ভুলতেই চাইবেন তিনি।

ওদিকে রোহিতের সাথে ব্যাট চালিয়ে যাচ্ছেন কোহলি। আগের ম্যাচেই ৫০তম ওডিআই সেঞ্চুরির মাইলফলক অর্জন করেছেন। এদিনও রান আর বলের হিসেবে গড়বড় নেই। এই দুই’য়ে মিলিয়ে খেলাই যার ব্যাটের অন্যতম সৌন্দর্য।

বাজিটা ম্যাক্সওয়েলকে দিয়েই নিয়েছেন অজি অধিনায়ক। আর বৃত্ত থেকে পিছন দিকে দৌড়ে গিয়ে যে ক্যাচ লুফে নিলেন ট্রাভিস হেড, তা হয়ত তাঁর জীবনের সেরা এক ফিল্ডিং হয়েই থাকবে। ৩ ছয় ও ৪ চারে সাজানো রোহিত শর্মার ইনিংসে তিন রান কম হয়ে যায় ফিফটির ছোঁয়া পেতে।

বাঁধ সেজেছিল এই মুহূর্তটা। রোহিত যাওয়ার পর আর তিন বলের ব্যবধানে প্যাট কামিন্সের শিকার হয়েছেন আইয়ার। কামিন্সের ব্যাক অব লেন্থ ডেলিভারিতে হালকা এজ, আর এতেই উইকেটরক্ষকের হাতে তালুবন্দি হয়েছেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা এই ব্যাটার।

শ্রেয়াস আইয়ার এর ফেরার পর এবার বিপর্যয় কাটানোর পালা ভারতের। নতুন ব্যাটার রাহুলের বল ও পিচের সংগ্রাম। আর কোহলির চলছিল সামঞ্জস্য রেখে ব্যাটিং।

তবে ভারতের ব্যাটাররা পিচের সাথে সংগ্রামটা কম করলেন না। কামিন্সের ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল, তারই প্রমাণ যেন বারবার দিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতীয় ব্যাটাররা। ধীরগতির পিচে, আরও ধীরে চলতে থাকল কোহলি ও রাহুল এর জুটি। এরমধ্যে দলীয় রান শতক ছাড়িয়ে যায়।

এই বিশ্বকাপে নিজের ৬ষ্ঠ ফিফটি পেতে ৫৬ বল খরচা করেন কোহলি। ফিফটির পর আর ইনিংসটা বড় করতে পারেননি। কামিন্সের সাথে আজ পিচের বোঝাপড়া দুর্দান্ত। আর তারই প্রমাণ রাখলেন আবারও।

খাটো লেন্থে দেওয়া বলে কোহলি হয়তো বের করে দিতে চেয়েছিলেন থার্ড ম্যান অঞ্চল দিয়ে। তা আর হয়নি। ইনসাইড হয়ে স্টাম্প খুঁজে নিয়েছে বল। পুরো আহমেদাবাদ জুড়ে নেমে আসে রাজ্যের নীরবতা। ভারতীয় এই নম্বর তিন ব্যাটার বিদায় নেন ৫৪ রানে।

ভারত তখন ৪ উইকেট হারিয়ে ১৪৮ রানে অবস্থান করছে।

লোকেশ রাহুল একপাশ সামলে তখনো ব্যাট করে যাচ্ছেন। সূর্যকুমার নয়, বরং জাদেজা এসেছেন ক্রিজে। রাহুলকে সঙ্গ দেওয়ার কাজটা খুব একটা ভালো করতে পারেননি। জশ হ্যাজেলউডের ডেলিভারিতে ফিরতে হয়েছে ৯ রান করে।

সূর্যকুমার’কে সঙ্গে নিয়ে রাহুল নিজের ফিফটি এবং দলীয় দুইশো রানের কোটা পূর্ণ করলেন। এবার ফেরার সময় এসে যায় তাঁরও। মিচেল স্টার্কের ব্যাক অব লেন্থ ডেলিভারিতে এজ হয়ে জশ ইংলিসের গ্লাভসে গিয়ে পড়ল রাহুলের ভাগ্য। ১০৭ বলে ৬৬ রান করে বিদায় নিতে হলো তাঁকে।

একপাশে সূর্যকুমার যাদব তখনো আস্থার প্রতিদান রাখতে পারছেন না। চল্লিশ ওভারের পর যাদবের কাছে যে-ধরনের ব্যাট আশা করে ভারত, সেখানে ব্যর্থতাই পরিলক্ষিত হয়েছে বটে। এরমধ্যে মোহাম্মদ শামি ও জাসপ্রীত বুমরাহ’কে ভারত হারিয়েছে ‘সিঙ্গেল ডিজিট’ এ। ৪০.৫ ওভারে ২০০ পেরোনো ভারত, রান এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছিল ওভারের পর ওভার।

সূর্যকুমার অনেকক্ষণ চেষ্টার পর যখন ফিরলেন, ভারতের দলীয় সংগ্রহ ৯ উইকেট হারিয়ে ২২৬ রান।

কুলদীপ যাদব বেশ কিছু বল খেলে তখনও ক্রিজে ছিলেন। আর ওদিকে মোহাম্মদ সিরাজ এসে কুলদীপ’কে সঙ্গ দিয়ে ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত মাঠে ছিলেন। দুইশো পেরোনো ভারত শেষ ওভারগুলিতে সুবিধাজনক কোনো খেলা খেলতে পারেনি।

শেষ বলে দুই রান নিতে গিয়ে কুলদীপ রানআউটের শিকার হলে ২৪০ রানে থেমে যায় স্বাগতিক দল।

৯৭ ডেস্ক

Read Previous

ফাইনালে অল্পতেই আটকে গেল ভারত

Read Next

দলের জন্য গর্বিত রোহিত, কৃতিত্ব দিলেন হেড-লাবুশেইনকে

Total
0
Share