

ক্রিকেটের উন্মাতাল হাওয়া এখন বাংলাদেশে। আবারও এসেছে বিশ্বকাপ। বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ দল মাঠে নামবে। পাশের দেশ ভারত থেকে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। কম দূরত্বের জন্য হাওয়াটা বোধহয় আরও তীব্র। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অর্জন ছোট ছোট কিছু আনন্দ। এখন পর্যন্ত এমনই হয়ে আসছে। খুব বড় অর্জন পাওয়া হয়নি। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ দল। এরপর একে একে ২০০৩, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ করে নতুন আরেক আসর শুরু করতে দল এখন রয়েছে ভারতে। বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ ‘জার্নি’ নিয়েই এই লেখা। নিজেদের খেলা প্রতিটি আসরে কেমন ছিল লাল-সবুজের দল, তাই উন্মোচনের চেষ্টা থাকবে এখানে।
১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি)। যা গঠিত হয়েছে ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর ক্রিকেট বোর্ড গঠন নিয়ে সেসময় নানাদিক থেকে বিরোধিতা ছিল। আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সেসময় বন্ধই হতে বসেছিল এসব বিরোধের কারণে।
আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করায় ধারাবাহিক ছিল বাংলাদেশ। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ আইসিসি ট্রফির ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। ফাইনাল ম্যাচে কেনিয়াকে ২ উইকেটে হারিয়ে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয় বাংলাদেশ। এই জয়ের মাধ্যমেই আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের সপ্তম আসরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। তখন বাংলাদেশে এ নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা ও উন্মাদনা চলছিল।
বাংলাদেশের জনগণ, সেই সময় ক্রিকেটের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিবর্গের জন্য খুব বেশি আনন্দের ছিল এসব ঘটনা। বাংলাদেশের সবাই তখন ব্যস্ত দিন গণনাতে। কবে আসবে পরের বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের মঞ্চে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা। পুরো দেশ যেন এক সুতোয় গাঁথা পড়ে যায়।
১৪ মে, ১৯৯৯ সাল
আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের সপ্তম আসর আয়োজন করে ইংল্যান্ড। এতে অংশগ্রহণ করে মোট ১২ টি দল। মোট ম্যাচ হয় ৪২ টি। ৯ টি পূর্ণ সদস্যের দলের সাথে ৩ টি সহযোগী দল নিয়ে সপ্তম বিশ্বকাপ শুরু হয়ে যায়। তিনটি সহযোগী দলের একটি বাংলাদেশ- যারা প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের মতোই আরেকটি দল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলছে সেবার, স্কটল্যান্ড। রাউন্ড রবিন ও নকআউট ফরম্যাটের এই টুর্নামেন্টে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নবাগত স্কটল্যান্ডের সাথে বি গ্রুপে ছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ; ১৯৯৯
প্রথম বিশ্বকাপ খেলার আনন্দ চোখে-মুখে নিয়ে বাংলাদেশ দল ইংল্যান্ডে পৌঁছে। বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিশ্বকাপ। দল নির্বাচন ও অন্যান্য আরও অনেক বিষয়াদি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ছিল সেসময়। আতাহার আলি খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু-সহ বেশ কিছু ক্রিকেটার সেসময়ে আলোচনার শীর্ষে ছিলেন। শুরুতে বাদ পড়া মিনহাজুল নান্নুকে পরবর্তীতে অনেকটা চাপের মুখে পড়েই দলে নিতে বাধ্য হয়েছিল ম্যানেজমেন্ট। এভাবেই নানারকম আলোচনা আর সমালোচনার মধ্যেই বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ স্কোয়াড তৈরি হয়।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ স্কোয়াড:
আমিনুল ইসলাম (অধিনায়ক), আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু,ফারুক আহমেদ, এনামুল হক, খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ (উইকেটরক্ষক), মোহাম্মদ রফিক, হাসিবুল হোসেন, মঞ্জুরুল ইসলাম, শফিউদ্দিন বাবু, নিয়ামুল রশিদ, নাইমুর রহমান দুর্জয়, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ও মেহরাব হোসেন অপি।
১৭ মে, ১৯৯৯ সাল
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচ, বিপক্ষ দল নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৩৭.৪ ওভারে ১১৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। বলার মতো রান করতে পারেননি কোন ব্যাটসম্যান। সর্বোচ্চ ১৯ রান করেছিলেন এনামুল হক। দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং করতে এসে ৩৩ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশের পক্ষে হাসিবুল হোসেন, মঞ্জুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিক ও নাইমুর রহমান দুর্জয় প্রত্যেকেই একটি করে উইকেট তুলে নেন। এবং দিনশেষে নিউজিল্যান্ড ৬ উইকেটে নিজেদের জয় তুলে নেয়। আর বাংলাদেশ তাদের বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ম্যাচেই হারের স্বাদ পায়।
প্রথম বিশ্বকাপে জয়ের স্বাদ
বাংলাদেশ দল তাদের প্রথম বিশ্বকাপে জয়ের স্বাদ পেয়েছে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে। এর আগে দ্বিতীয় ম্যাচ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল তাদের। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এসে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে একটু বিমর্ষই ছিল দল। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচে তাদের মতোই বিশ্বকাপে নব্য দল স্কটল্যান্ডকে সেদিন পরাজিত করে, প্রথম ম্যাচ জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ।
সেদিন বাংলাদেশ শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ১৮৫ রান সংগ্রহ করে ৯ উইকেট হারিয়ে, ৫০ ওভার শেষে। সর্বোচ্চ ৬৮ রানের ইনিংস খেলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। জবাবে ব্যাট করতে নেমে স্কটল্যান্ড ৪৬.২ ওভারে ১৬৩ রানে নিজেদের ইনিংস গুটিয়ে ফেলে। হাসিবুল হোসেন, মঞ্জুরুল ইসলাম,খালেদ মাহমুদ প্রত্যেকে ২ টি করে উইকেট লাভ করেন।
স্বাভাবিকভাবেই সেই জয়ে দল চনমনে মেজাজেই ছিল। এরপর চতুর্থ ম্যাচ ছিল শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ দল সংগ্রহ করে ৫০ ওভারে মাত্র ১৭৮ রান। ৫৩ রান করে এদিনও সর্বোচ্চ রান করেন মিনহাজুল আবেদিন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৯.৫ ওভারে অস্ট্রেলিয়া জয়ের দ্বারপ্রান্ত ছুঁয়ে ফেলে। কিন্তু বাংলাদেশ দলের নাটকীয়তা তখনো বাকি।
৩১ মে, ১৯৯৯ সাল
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিজেদের গ্রুপের শেষ ম্যাচে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, সাইদ আনোয়ার, শোয়েব আক্তারদের নিয়ে গড়া ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দল তখন পাকিস্তান। তার বিপরীতে প্রথম বিশ্বকাপ খেলা বাংলাদেশ।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খানের ৪২, শাহরিয়ার হোসেনের ৩৯- এমন কিছু কিছু সংগ্রহে ৫০ ওভার শেষে ২২৩ রান তোলে বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় পাকিস্তান। দলীয় ৪২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। এরপর নিয়মিত উইকেট বিরতিতে ১৬১ রানে থামে দলীয় ইনিংস। মিনহাজুল আবেদিন, খালেদ মাহমুদ, নাইমুর রহমান দুর্জয় প্রত্যেকেই নেন ২ টি করে উইকেট। আর বাংলাদেশ পায় তাদের প্রথম বিশ্বকাপের দ্বিতীয় জয়। ঐতিহাসিক সে জয়।
এদিন পুরো বাংলাদেশে আনন্দ বয়ে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় যেন জয়ের চেয়েও বেশি কিছু। ইংল্যান্ডের কাউন্টি গ্রাউন্ড স্টেডিয়ামে দর্শকদের বাঁধভাঙা উল্লাস নজর কেড়েছে সবার। শেষ উইকেট পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে দর্শকরা যেভাবে ছুটে গিয়েছেন মাঠে, সেটি আজও চকচকে স্মৃতি হয়ে আছে দেশের ক্রিকেটে। এদিন ইংল্যান্ডে ইতিহাসই রচনা করেছিল লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির বিশ্বকাপ; ২০০৩
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অষ্টম আসর বসে ২০০৩ সালে। প্রথমবারের মতো আফ্রিকা মহাদেশে আয়োজিত হয়েছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেট। তিন দেশ; সাউথ আফ্রিকা, কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে মিলে আয়োজকের দায়িত্ব পালন করেছে। ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের কাছে সবারই প্রত্যাশা ছিল কিছুটা হলেও। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশ ততদিনে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় নিয়মিত দল হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে।
২০০৩ বিশ্বকাপ স্কোয়াড:
খালেদ মাসুদ (উইকেটরক্ষক ও অধিনায়ক), অলক কাপালি, আল শাহরিয়ার রোকন, এহসানুল হক, হাবিবুল বাশার, হান্নান সরকার, খালেদ মাহমুদ, মঞ্জুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আশরাফুল, মোহাম্মদ রফিক, সানোয়ার হোসেন, তালহা জুবায়ের, তাপশ বৈশ্য, তুষার ইমরান ও মাশরাফি বিন মর্তুজা।
প্রায় অধিকাংশ নতুন মুখ নিয়ে সাজানো দলটি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। আকরাম খানকে বাদ দিয়ে স্কোয়াড সাজানো হয়েছিল, যেটি নিয়ে নানারকম কথা হয়েছে। আর এদিকে মাঠের খেলায় গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচ হেরে বসে বাংলাদেশ। পুরো দল থেকে শুরু করে দেশের মানুষ- সবাই অনেক বেশি আশাহত হয় সেবার।
রাউন্ড রবিন পদ্ধতির টুর্নামেন্টে পুল- বি তে ছিল বাংলাদেশ দল। প্রথম ম্যাচ ছিল অনভিজ্ঞ কানাডা’র বিপক্ষে। যারা ১৯৭৯ সালের পর আর কোন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। সেই দলের বিপক্ষে ৬০ রানে হেরে বসে বাংলাদেশ। এরপর একে একে গ্রুপের অন্যান্য দল; শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এবং গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে কেনিয়ার সাথেও হেরে বসে তাঁরা।
মাঝখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ম্যাচ বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল। যার ফলে বাংলাদেশ তাদের ৬ ম্যাচের ৫ টি হেরে যায়, আর একটি হয় পরিত্যক্ত। গ্রুপ তালিকার তলানিতে থেকে সেবার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। সেবারের বিশ্বকাপ ছিল শুধুই আক্ষেপের। এর বেশি আর কিছু নয়।
বাংলাদেশের স্মরণীয় বিশ্বকাপ; ২০০৭
বিশ্বকাপের নবম আসর। ১৬ দল আর ৫১ ম্যাচ নিয়ে রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ওয়েস্ট ইন্ডিজে। স্কোয়াডের প্রায় ১০ জন নতুন সদস্য, যারা কিনা এর আগের বিশ্বকাপ খেলে নি। নতুন এবং অভিজ্ঞ ৫ জন নিয়ে ২০০৭ বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজমেন্ট। সেবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যান একসাথে বর্তমানের তিন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ক্রিকেটার; সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবাল।
২০০৭ বিশ্বকাপ স্কোয়াড:
হাবিবুল বাশার (অধিনায়ক), শাহরিয়ার নাফিস, আব্দুর রাজ্জাক, আফতাব আহমেদ, জাভেদ ওমর বেলিম, মাশরাফি বিন মতুর্জা, মোহাম্মদ আশরাফুল, মোহাম্মদ রফিক, মুশফিকুর রহিম, রাজিন সালেহ, শাহাদাৎ হোসেন, সাকিব আল হাসান, সৈয়দ রাসেল, তামিম ইকবাল ও তাপস বৈশ্য।
এ, বি, সি, ডি- মোট চার গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয় ১৬ টি দলকে। বাংলাদেশ চলে যায় গ্রুপ বি তে। যেখানে তাদের বাকি প্রতিপক্ষ ছিল ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বারমুডা।
বি গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল ১৭ মার্চ, কুইন্স পার্ক ওভালে। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত। ভারতের অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই মোটামুটি ধাক্কা খেয়ে বসে ভারত।
মাশরাফির বলে এজ হয়ে ফিরে যান বিরেন্দর শেবাগ। দলীয় মাত্র ৬ রানে প্রথম উইকেট হারায় ভারত। এরপর দলের রান যখন ২১, তখন দ্বিতীয় উইকেট এবং দলীয় ৪০ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে বসে ভারতীয় দল। এরপর সৌরভ গাঙ্গুলি ও যুবরাজ সিং কিছুটা চেষ্টা করেন দলকে টেনে তুলতে। কিন্ত খুব বেশিদূর যাওয়া হয়ে ওঠে না ভারতের, ১৯১ রানেই অলআউট হতে হয়। এদিন মাশরাফি বিন মর্তুজা একাই নেন ৪ উইকেট। আব্দুর রাজ্জাক ও মোহাম্মদ রফিক প্রত্যেকে নেন ৩ টি করে উইকেট।
১৯২ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৪৮.৩ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। এদিন প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে নামা তামিম ইকবাল ৫৭, মুশফিকুর রহিম ৫৬ ও সাকিব আল হাসান ৫৩ রান করে দলের জয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সেবার ভারতকে হারিয়ে ইতিহাসই ঘটায় বাংলাদেশ। পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে ভারতকে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার সাথে হারলেও, বারমুডাকে পরাজিত করে সুপার এইট নিশ্চিত করে ফেলে।
সুপার এইটের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১০ উইকেটে হেরে বসে বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের কাছে ৯ উইকেটে হেরে যায় তাঁরা। পরপর দুই ম্যাচে এরকম শোচনীয় হারে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা হতাশা ছিল দলের মধ্যে।
পরের ম্যাচ ছিল প্রোভিডেন্স স্টেডিয়ামে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশকে নিয়ে তেমন চাপ নেওয়ার কথা নয় তখন। কিন্ত সেই বাংলাদেশ সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেখিয়ে দিতে পেরেছিল নিজেদের সামর্থ্য।
টসে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮৭, তামিম ইকবালের ৩৮, আফতাব আহমেদের ৩৫ রানের উপর ভর করে ৫০ ওভার শেষে বাংলাদেশ ২৫১ রান করতে সক্ষম হয়। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিংয়ে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। হার্শেল গিবসের অপরাজিত ৫৬ আর জ্যাক ক্যালিসের ৩২ রান। এছাড়া বলার মতো রান আসেনি কারও ব্যাট থেকে। ফলে ১৮৪ রানেই অল আউট হয়ে যায় প্রোটিয়ারা। বাংলাদেশের পক্ষে আব্দুর রাজ্জাক একাই নেন ৩ উইকেট।
দুই ম্যাচ হারের পর সুপার এইটে বাংলাদেশের প্রথম জয়, তাও আবার দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পরাশক্তির বিপক্ষে। বাংলাদেশের জন্য এটা ছিল দারুণ আনন্দের এবং ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরবর্তী তিন ম্যাচের তিনটি’ই হেরে ২০০৭ বিশ্বকাপের সুপার এইট পর্ব থেকেই বিদায় নেয় বাংলাদেশ। আর এরসাথেই কিছু প্রাপ্তি ও কিছু দুঃখ- দু’ই নিয়েই দেশে ফেরে লাল-সবুজের দল।
আয়োজক দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ; ২০১১
আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১০ম আসর অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ মিলে এই বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সে বছর বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ। বাংলাদেশের দুই ভেন্যুতে মোট ৮ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ভেন্যু দুটি ছিল শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুর ও জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম।
টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার দুই দিন আগে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন হয়েছিল। রাউন্ড রবিন পদ্ধতির এই টুর্নামেন্টে মোট ১৪ দল অংশগ্রহণ করে। মোট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ৪৯ টি। ২০১১ বিশ্বকাপের থিম সং ‘দে ঘুমাকে’ বা ‘মার ঘুরিয়ে’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দু’টি গ্রুপে ১৪ টি দলকে ভাগ করা হয় এবং বাংলাদেশ অবস্থান করে গ্রুপ বি তে।
২০১১ বিশ্বকাপ স্কোয়াড:
সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, শাহরিয়ার নাফিস, আব্দুর রাজ্জাক, ইমরুল কায়েস, জুনায়েদ সিদ্দিকী, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহিম, নাইম ইসলাম, নাজমুল হোসেন, রকিবুল হাসান, রুবেল হোসেন, সোহরাওয়ার্দি শুভ ও শফিউল ইসলাম।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১১
উদ্বোধনী ম্যাচেই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ২৭ হাজার আসন সেদিন লোকে লোকারণ্য ছিল। নিজেদের মাঠে প্রথম বিশ্বকাপ, প্রথম ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ২০০৭ বিশ্বকাপে ইতিহাস সৃষ্টি করে হারিয়ে দেওয়া সেই ভারত। বাংলাদেশ টসে জয়লাভ করে শুরুতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভারত শুরুতে ব্যাট করে বিশাল এক লক্ষ্য ছুড়ে দেয় বাংলাদেশের দিকে।
৩৭১ রানের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে বাংলাদেশ খুব যে খারাপ করে তা না। বেশ ভালোভাবে শুরু করলেও, বেশিদূর আগাতে পারেনি তারা। তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান এর ব্যাট থেকে আসে অর্ধশতক। জুনায়েদ সিদ্দিকী, ইমরুল কায়েস থেকে আসা ৩০+ ইনিংসও বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত জেতাতে পারেনি। ৫০ ওভার শেষে ২৮৩ রানে থামে বাংলাদেশের আশা জাগানো ব্যাটিং। শেষ পর্যন্ত ৮৭ রানের হার নিয়েই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ শেষ করে দল।
নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। তৃতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মিরপুরে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচটি খুব বাজেভাবেই হেরে বসে বাংলাদেশ দল। সেদিন সাকিবের দল সর্বনিম্ন ওয়ানডে সংগ্রহ ৫৮ রান করে গুটিয়ে যায়। দেশের মাটিতে খেলা বিশ্বকাপে বেশ লজ্জার মধ্যেই পড়তে হয় এই ঘটনায়।
পরের তিন ম্যাচ নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। নেদারল্যান্ডসের সাথে তো বটেই, ইংল্যান্ডের সাথেও ঐতিহাসিক জয় পেয়ে বসে সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ। কিন্তু উইন্ডিজের পর বাজেভাবে হারতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেও। ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জা না কাটতেই, আবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ দল।
১১ মার্চ, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ২২৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ বেশ ভালোই শুরু করে কিন্ত মিডল অর্ডারের ব্যাটিং বিপর্যয়ে শেষ ভাল নিয়ে শঙ্কা ছিল যথেষ্ট। সেই সময় যেন ব্যাটিংয়ে ‘দূত’ হয়ে আবির্ভাব হলেন শফিউল ইসলাম। দলের যখন ৮ উইকেট পড়ে গেছে, তখন শফিউল ইসলাম খেললেন ২৪ বলে ২৪ রানের এক স্মরণীয় ইনিংস। অপর প্রান্তে থাকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ পেলেন ভরসা। আর বাংলাদেশ দল পেল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নিজেদের ঐতিহাসিক এক জয়, যা কি না বিশ্বকাপের মঞ্চে, নিজেদের মাটিতে।
পয়েন্টে সমান থাকলেও, নেট রান-রেটে এগিয়ে থেকে পরের পর্ব নিশ্চিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর বাংলাদেশের ২০১১ বিশ্বকাপ-পর্ব গ্রুপ পর্যায়ের খেলাতেই শেষ হয়। একমাত্র অর্জন হয়ে দাঁড়ায় ইংলিশদের হারানোর স্মৃতি।
সৌভাগ্য-দূর্ভাগ্যের বিশ্বকাপ; ২০১৫
২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপ আইসিসি কর্তৃক ১১তম আসর। রাউন্ড রবিন-নক আউট পদ্ধতির এই বিশ্বকাপে মোট ১৪ দল অংশগ্রহণ করে। মোট ম্যাচ হয় ৪৯ টি। ২০১৫ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড যৌথভাবে। অস্ট্রেলিয়ায় মোট ২৬ টি ও নিউজিল্যান্ডে মোট ২৩ টি খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৫ বিশ্বকাপ স্কোয়াডঃ
মাশরাফি বিন মতুর্জা (অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, এনামুল হক বিজয়, সাকিব আল হাসান, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, নাসির হোসেন, সৌম্য সরকার, তাইজুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ, আল আমিন হোসেন, রুবেল হোসেন, সাব্বির রহমান ও আরাফাত সানি।
১৪ দলের এই বিশ্বকাপে দুইটি গ্রুপ হয়, এ ও বি। প্রতিটি দলকে এই দুই গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি, বিপক্ষ আফগানিস্তান। বাংলাদেশ দল শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ২৬৭ রান সংগ্রহ করে, ৫০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে। জবাবে আফগানিস্তান ব্যাট করতে নেমে ১৬২ রানেই নিজেদের সব উইকেট হারিয়ে বসে। ফলাফল, লাল সবুজের দল তাদের পঞ্চম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ১০৫ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় লাভ করে।
এরপরের ম্যাচ স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কিন্ত বৃষ্টির কারণে সে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। ফলে উভয় দল ১ টি করে পয়েন্ট ভাগ করে নেয়। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা শুরুতে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ দলকে ৩৩৩ রানের বিশাল লক্ষ্য ছুড়ে দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৪৭ ওভার খেলে ২৪০ রানেই অল আউট হয়ে যায়। তৃতীয় ম্যাচে লঙ্কানদের কাছে পরাজিত হতে হয় মাশরাফির দলকে।
বাংলাদেশের পরের ম্যাচ ছিল পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ থেকে দুর্বল প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ডের সাথে। তথাকথিত দুর্বল প্রতিপক্ষ হলেও শুরুতে ব্যাট করতে নেমে স্কটল্যান্ড ৩১৯ রানের টার্গেট ছুড়ে দেয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ব্যাট করতে নেমে বেশ ভালোভাবেই এই রান তাড়া করে। তামিম ব্যক্তিগত ৯৫ রান করেন। মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক, সাকিব- তিন জন পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেন। ফলে ৪৮.১ ওভার হতেই বাংলাদেশ তাদের কাঙ্ক্ষিত জয় পেয়ে যায়।
পরের ম্যাচটি ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এদিন শুরুতে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৭ উইকেট হারিয়ে ২৭৫ রান সংগ্রহ করে। বাংলাদেশের একটি ইতিহাসও রচিত হয় একইদিনে। প্রথম কোন বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চে শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আগের ম্যাচেই তামিম যেখানে ৯৫ করে আউট হয়ে আশাহত করেছিলেন। মাহমুদউল্লাহ যেন সেদিন সেই আয়োজনটাই নিজের করে নিলেন। ১০৩ করে রান আউট হয়ে ফেরেন রিয়াদ।
২৭৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে, সহজ খেলাকে মোটামুটি জটিল করে ফেলে ইংল্যান্ড। রুবেল হোসেনের অসাধারণ বোলিং তোপ, সাথে দলের সবার ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ২৬০ রানেই অল আউট হয়ে যায় ইংলিশরা। ফলাফল বাংলাদেশ ১৫ রানে জয়ী।
বাংলাদেশের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় স্বাগতিক দেশ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। নিউজিল্যান্ড সেদিন তিন উইকেটে জিতে গেলেও, বাংলাদেশ বেশ দারুণ খেলেছিল মাঠে। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি পাওয়া মাহমুদউল্লাহ সেদিনও ১২৮ রান করে অপরাজিৎ ছিলেন। বাংলাদেশের দেওয়া ২৮৯ রানের লক্ষ্য নিউজিল্যান্ড ৪৮.৫ ওভারেই পেরিয়ে যায়। ফলে ম্যাচটি হেরে যায় বাংলাদেশ।
গ্রুপ পর্বে মোট ছয়টি ম্যাচ খেলে, তিন জয় ও দুই পরাজয় নিয়ে পরের পর্বে কোয়ালিফাই করে মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ। আর পরের পর্বে (কোয়ার্টার ফাইনাল) বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে আসে ভারত।
১৯ মার্চ, ২০১৫
ভারত বনাম বাংলাদেশের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ভারত ৩০২ রানের একটি ভাল সংগ্রহ দাঁড় করে। রোহিত শর্মা একাই করেন ১৩৭ রান। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাট করতে নেমে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ৩৩ রানেই প্রথম ২ উইকেট পড়ে যায় বাংলাদেশের। এরপর মাঠের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশের ‘পক্ষে’ সেদিন তেমন কিছুই ছিল না। ফলাফল ১৯৩ রানে অল আউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। এবং নক আউট পর্বের ম্যাচে, এখান থেকেই বিশ্বকাপ শেষ করতে হয় তাদের।
সেদিনের সেই ম্যাচ নিয়ে পরে বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক হয়েছে। সে যাইহোক, ২০১৫ বিশ্বকাপ বিভিন্নভাবে যেমন বাংলাদেশ দলের জন্য সৌভাগ্য হয়ে ছিল আবার বিভিন্ন ছোট ছোট কারণে এটি দুর্ভাগ্যেরও বিশ্বকাপ। তবে বাংলাদেশের আলাদা শক্তির জায়গা তৈরি হয় এই বিশ্বকাপের পর থেকেই।
আশার ভেলায় হতাশার বিশ্বকাপ; ২০১৯
নিজেদের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ খেলার অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। মে মাসের শেষ সপ্তাহে আসর বসেছিল ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসে। আগের পাঁচটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ২০১৫ বিশ্বকাপে এই সাফল্য ছুঁয়েছিল বাংলাদেশ।
২০১৯ বিশ্বকাপ স্কোয়াড:
তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম (উইকেটরক্ষক), মোহাম্মদ মিঠুন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মেহেদী হাসান মিরাজ, মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক), রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, আবু জায়েদ রাহী।
২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে পাল্টে যাওয়া দল, আর অন্যরকম ক্রিকেট খেলার যে যাত্রা শুরু করেছিল টাইগাররা, সে পথ ধরে সাফল্য রেখাটা ঊর্ধ্বগামী হয়েছে দিনকে দিন। তাই ২০১৯ বিশ্বকাপে স্বপ্ন ও আশা- দুটোই ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ১০ দলের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিজেদের অষ্টম অবস্থানে রেখে টুর্নামেন্ট শেষ করে।
প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১ রানে হারিয়ে দারুণ শুরু করে বাংলাদেশ দল। দল ও দেশের মানুষ আশা করতে থাকে, এবার বুঝি খুব ভালো কিছুই হতে যাচ্ছে। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয় দল। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে জয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরাজয় ও আফগানিস্তান দলকে হারিয়ে দিলে আবারও কিছু আশা খুঁজে পায় বাংলাদেশ। মাঝে শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয় বৃষ্টির কারণে। কিন্তু পরের দুই ম্যাচ ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষেও হারের স্বাদ পেতে হয় লাল-সবুজের দলটিকে। ফলে ৩ ম্যাচের বেশি জয় নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেনি দল।
সেই বিশ্বকাপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিল ‘সাকিব আল হাসান’কে নিয়ে। সেটা যেন সাকিবের ব্যক্তিগত বিশ্বকাপ ছিল। ৩ নম্বরে ব্যাট করে ৮৬.৫৭ গড় নিয়ে ৬০৬ রান ও সাথে ১১ উইকেট- ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার দৌড়েও এগিয়ে ছিলেন এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। কিন্তু দল যে বাদ পড়েছে গ্রুপ পর্বেই। দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের মধ্যে লিটন দাস, মুশফিকুর রহিম, মোস্তাফিজুর রহমান- তাঁরাও ছিলেন। এছাড়া প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনও বেশ ভাল করেন গত বিশ্বকাপে, ১৩ উইকেট ছিল পকেটে, সাথে ব্যাট হাতেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৯ রান এবং ভারতের বিপক্ষে একটি ফিফটি আদায় করে নেন।
চলমান বিশ্বকাপ; ২০২৩
বিশ্বকাপের ১৩তম আসর। বাংলাদেশের জন্য সপ্তম বিশ্বকাপ। এবারের আসর অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ২০১৯ বিশ্বকাপের মতোই রাউন্ড-রবিন পদ্ধতিতে ম্যাচগুলি হবে। ৫ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এই মহারণ।
এবারের বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দল ও খেলোয়াড়দের নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক হতে দেখা গেছে। স্কোয়াড ঘোষণার শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ নিজেদের দল ঘোষণা করেছে। দলে তামিম ইকবাল থাকার কথা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত ইনজুরি ও আরও কিছু জটিলতার কারণে দলে নেই তিনি।
২০২৩ বিশ্বকাপ স্কোয়াড:
সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), নাজমুল হোসেন শান্ত (সহ-অধিনায়ক), লিটন দাস, তানজিদ হাসান তামিম, তাওহীদ হৃদয়, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, নাসুম আহমেদ, শেখ মেহেদী হাসান, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, হাসান মাহমুদ, শরিফুল ইসলাম, তানজিম হাসান সাকিব।
দলের দায়িত্বভার সাকিব আল হাসানের কাঁধে। দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের অধিনায়ক সাকিব। ১৫ সদস্যের স্কোয়াডে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব- এই ত্রয়ী সবচেয়ে অভিজ্ঞ। ৮ জন ক্রিকেটার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলছেন। এর আগে এশিয়া কাপ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজে বাংলাদেশ দলের পারফর্ম্যান্স ছিল বেশ হতাশাজনক।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল কেমন করবে, তা আসলে খুব একটা অনুমান করা যাচ্ছে না। যদিও বছরের শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল, ভারত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অন্যতম সেরা প্রতিযোগী হয়ে অংশ নিবে। বাংলাদেশ দলের প্রথম ম্যাচ ৭ অক্টোবর, আফগানিস্তানের বিপক্ষে। সেই অপেক্ষাতেই আপাতত দিন গুনছে দেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।
তবে ১৯৯৯ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যেয়েই শক্তিশালী পাকিস্তান দলকে হারায় বাংলাদেশ। সেবার দুই জয় নিয়ে ফেরে। অন্য চার বিশ্বকাপের প্রত্যেকটিতে তিনটি করে জয়। ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে দু’বার-সহ ভারত’কেও বিশ্ব আসরে হারানোর অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের। শুধু ২০০৩ বিশ্বকাপে কোন ম্যাচ জিততে পারেনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। আপাতত চোখ ২০২৩ বিশ্বকাপে। সাকিবের নেতৃত্বে অভিজ্ঞতা ও তরুণের মিশেলে এই দল কেমন করে, তাই জানা যাবে আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে। শুভকামনা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।