

‘ফ্যাব ফোর’, ইংরেজিতে ‘FAB FOUR’- এর উৎপত্তি করেছিলেন সাবেক নিউজিল্যান্ড কিংবদন্তি মার্টিন ক্রো। কারা ছিলেন এই ফ্যাব ফোর? ছিলেন না, বরং এখনো আছেন। ভিরাট কোহলি (ভারত), স্টিভ স্মিথ (অস্ট্রেলিয়া), জো রুট (ইংল্যান্ড), কেন উইলিয়ামসন (নিউজিল্যান্ড)। এই চার ক্রিকেটার। খুব পরিচিত তাঁরা। তাঁদের কর্মে, গুণে, রানে, মাঠে।
এই চার ক্রিকেটার এখন আছেন। তবে খুব শীঘ্রই তাঁরা ‘ছিলেন’ হয়ে যেতে পারেন। ক্রিকেটীয় দিক থেকে অবশ্যই। আসন্ন বিশ্বকাপের দিকে তাকালেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, এই চারজন’কে একসাথে শেষ কোন বিশ্ব আসরে এক হতে দেখা যাবে হয়তো এবারই, শেষবারের মতো।
এই সময়ের ফুটবলের দিকে তাকালে মেসি, রোনালদো থেকে শুরু করে অনেক ফুটবলার, যারা হয়তো একসাথে নিজেদের বিভিন্ন বড় টুর্নামেন্টের শেষ খেলে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। ক্রিকেটেও হয়তো সেই সময়টা এসে গেছে। কোহলি, স্মিথ, রুট, উইলিয়ামসন- তাঁদের নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে সবসময়। তাঁরা ছিলেন গত কয়েক বছরের ক্রিকেটের অনেকটুকু জুড়ে।
বয়সের দিকে তাকানো যাক। কোহলি, যিনি সামনের নভেম্বরে ৩৫ এ পা দিচ্ছেন। স্মিথ, তাঁর এখন ৩৪ বছর। ডিসেম্বরে রুট যাচ্ছেন ৩৩ এর দিকে। উইলিয়ামসনের ৩৩ বছর চলছে। তাঁরা আর যুবক নেই কেউ। তাই বলা যায় যে, একসাথে এই ‘চার’কে দেখার সুযোগ বোধহয় এবারই শেষ।
সংখ্যায় ‘চার’ জন
ভিরাট কোহলি: কোন সন্দেহ ছাড়া কোহলি সবার থেকে এগিয়ে থাকবে ৩ সংস্করণে। ২৮০ ওডিআই ম্যাচে ৫৭.৩৯ গড়ে এই ব্যাটারের রান ১৩ হাজার ২৭। সর্বোচ্চ সংগ্রহ ১৮৩ রান। সেঞ্চুরি আছে ৪৭ টি। হাফ সেঞ্চুরি ৬৫ টি। শচীন টেন্ডুলকারের পর ভারতের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।
এই টপ অর্ডার ব্যাটার ২০১১ সাল থেকে ২৬ টি বিশ্বকাপ ম্যাচে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ৪৬.৮১ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ১ হাজার ৩০ রান। এই ২৬ ম্যাচে ২ টি সেঞ্চুরি ও ৬ টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ সেখানে ১০৭ রান। এখানেও শচীনের পর ভারতের হয়ে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাঁর। ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন এই ক্রিকেটার।
সর্বশেষ ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ কোহলির ব্যক্তিগত সংখ্যার দিক থেকে সেরা ছিল। ৫৫.৩৮ গড়, ৫ হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে ৪৪৩ রান সংগ্রহে ছিল তাঁর। বিশ্বকাপের সেরা ১০ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ছিলেন, ভারতের পক্ষে ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
২০২৩, বিশ্বকাপের বছর কোহলি সব সংস্করণেই ভাল ক্রিকেট খেলেছেন। ১৪ টি ওডিআই ম্যাচে ১২ ইনিংসে ব্যাট করে সাড়ে ৫৫ এর কিছু বেশি গড় নিয়ে সংগ্রহ করেছেন ৫৫৬ রান। সর্বোচ্চ যেখানে ছিল অপরাজিত ১৬৬ রান।
স্টিভ স্মিথ: বলা হয়ে থাকে, ডন ব্রাডম্যানের পর অস্ট্রেলিয়ার ‘গ্রেটেস্ট’ টেস্ট ব্যাটসম্যান। ১৪২ টি ওডিআই ম্যাচ খেলেছেন। ৪৪.৪৯ গড়ে ৪ হাজার ৯৩৯ রান করেছেন। ১২ টি সেঞ্চুরি ও ২৯ টি হাফ সেঞ্চুরির মালিক এই অজি ব্যাটার। সর্বোচ্চ সংগ্রহ ১৬৪ রান।
বিশ্বকাপে খেলেছেন ২৪ টি ম্যাচ, ২০১১ সাল, তাঁর অভিষেক সময় থেকে। ৪৬.৩৩ গড় নিয়ে করেছেন ৮৩৪ রান। আছে ১ সেঞ্চুরি ও ৮ টি হাফ সেঞ্চুরি। ২০১৫ বিশ্বকাপ ছিল স্মিথের জন্য স্বপ্নের মতো। সেবার অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়। স্মিথ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, টুর্নামেন্টে ৬ষ্ঠ। ৮ ম্যাচ খেলে ৬৭ গড়ে সংগ্রহ করেছিলেন ৪০২ রান। এক সেঞ্চুরি ও ৪ টি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন সেই টুর্নামেন্টে।
এবার বিশ্বকাপের বছরে মাত্র ৩ ম্যাচে ২ ইনিংস ব্যাট করেছেন স্মিথ। রান করেছেন ২২। ভারতে তাঁর দলের জন্য ভালো কিছু করতে মুখিয়ে থাকবেন এই ব্যাটার। বর্তমানে ইনজুরি থেকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আছেন।
জো রুট: ১৬২ ওডিম্যাচ খেলেছেন। প্রায় ৪৯ গড়ে রান করেছেন ৬ হাজার ২৪৬। হাফ সেঞ্চুরি ৩৬ টি, সেঞ্চুরি ১৬ টি। সর্বোচ্চ সংগ্রহ অপরাজিত ১৩৩ রান। এউইন মরগান- এর পর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ওডিআই রান সংগ্রাহক এই ব্যাটার।
২০১৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন রুট। মোট ১৭ টি ম্যাচে ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্ব আসরে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ৫৪.১৪ গড়ে ৭৫৮ রান আছে তাঁর সংগ্রহে। আছে ৩ সেঞ্চুরি ও ৩ হাফ সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপে তাঁর সর্বোচ্চ সংগ্রহ ১২১ রান। গ্রাহাম গুচের পর ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।
সর্বশেষ ২০১৯ বিশ্বকাপ রুটের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ইংল্যান্ড। দলের হয়ে ১১ ইনিংস ব্যাট করে ৬১ এর উপরে গড় নিয়ে ৫৫৬ রান সংগ্রহ করেন এই ব্যাটার। সাথে ছিল ২ সেঞ্চুরি ও ৩ হাফ সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ও টুর্নামেন্টের পঞ্চম শীর্ষ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি।
২০২৩ সালে রুট মাত্র ৩ টি ওডিআই খেলেছেন। করেছেন মাত্র ১০ রান। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের হয়ে রুট হয়তো এবারও নিজেকে রাঙাতে চাইবেন। উল্লেখ্য যে, চলমান আয়ারল্যান্ড সিরিজের দলে রুট ছিলেননা। তবে নিজের ইচ্ছাতেই এই সিরিজ খেলতে চেয়েছেন তিনি, হয়তো বিশ্বকাপের আগে নিজেকে আরেকটু ঝালিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা।
কেন উইলিয়ামসন: নিউজিল্যান্ডের কাণ্ডারি উইলিয়ামসন। খেলেছেন মোট ১৬১ ওডিআই ম্যাচ। প্রায় ৪৮ গড় নিয়ে করেছেন ৬ হাজার ৫৫৪ রান। আছে ১৩ টি সেঞ্চুরি ও ৪২ টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ সংগ্রহ ১৪৮ রান। নিউজিল্যান্ডের হয়ে পঞ্চম সর্বোচ্চ ওডিআই রানের মালিক তিনি।
২০১১ সালে বিশ্বকাপ অভিষেক হয় উইলিয়ামসনের। ২৩ ম্যাচ খেলে প্রায় ৫৭ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ৯১১ রান। সাথে ২ সেঞ্চুরি ও ৩ হাফ সেঞ্চুরি। সর্বশেষ ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ উইলিয়ামসনের জন্য আনন্দের ছিল বলতে হবে, একই সাথে বেদনারও অবশ্য। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টানটান সেই ফাইনাল হারের ক্ষতও সেখানে ছিল। সেবার ১০ ম্যাচে ৮২.৫৭ গড়ে রান করেছেন ৫৭৮। ২ টি সেঞ্চুরি ও ২ টি হাফ সেঞ্চুরি ছিল তাঁর। সর্বোচ্চ সংগ্রহ ১৪৮ রান। টুর্নামেন্টের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি এবং নিউজিল্যান্ডের পক্ষে শীর্ষে। জিতেছিলেন ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’ পুরস্কার।
২০২৩ সালে ৩ ম্যাচে ২ ফিফটি নিয়ে ১৬৪ রানের সংগ্রহ উইলিয়ামসনের। এ বছরের আইপিএল চলাকালীন সময়ে চোটে পড়েছিলেন এই ব্যাটার। তখন থেকে আর ক্রিকেটে ফেরা হয় নি। দীর্ঘ সময় চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে গেছেন। তবে কিছুদিন আগে দলের সাথে যুক্ত হয়েছেন তিনি। করছেন অনুশীলন, একইসাথে চলছে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। আসন্ন বিশ্বকাপে মাঠে নামতে পারবেন কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে উইলিয়ামসন’কে অধিনায়ক করেই প্রাথমিক স্কোয়াড ঘোষণা করেছে নিউজিল্যান্ড।
সকল শেষ ঘনিয়ে আসে। ফুরিয়ে আসে আয়োজন। বিশ্বকাপের আসরে একইসাথে পরিচিত এই চার ক্রিকেটার-কে দেখার সময়ও যেন ঘনিয়ে এসেছে। ভারতের মাটিতে, বিশ্বকাপের আয়োজনে; অনেককিছুর সাথে এ কথাও স্মরণ রাখুক ক্রিকেট-প্রেমী জনগণ।
মঈন হাসান, ক্রিকেট৯৭