

‘ব্যাটারদের ব্যর্থতা’ ছাড়া একে আর কোনো শব্দমালা দিয়ে নিরূপণ সম্ভব নয়। চিরাচরিতভাবে ঐ কিছু রানের স্বল্পতা বাংলাদেশ দলের জন্য যেন থেকেই যায়। দুশো রানও পেরোতে পারেনি যে দল, তাঁদের জন্য ম্যাচে থাকা খুব কঠিনই বৈকি। বাংলাদেশ পারেনি। এশিয়া কাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫ উইকেটের হার দেখতে হয়েছে দলটির।
নাজমুল হাসান শান্তর থেকে সেঞ্চুরি আসেনি, এসেছে ৮৯ টি জরুরী রান। এছাড়া আর কোনো ব্যাটার দায়িত্ব নিতে পারেননি। ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। কেউ কেউ এই মিছিল ছেড়ে বেরিয়ে এলেও পারতেন, তা কেউ করেননি, শান্ত ছাড়া। এসবের ফলে ১৬৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড় করায় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা লক্ষ্যে পৌঁছে যায় খুব সহজেই। উইকেট পড়েছিল, তবে চাপ বেশিক্ষণ নিতে হয়নি। সাদিরা সামারাবিক্রমা ও চারিথ আসালাঙ্কার হাফ-সেঞ্চুরিতে ম্যাচ বের হয়ে যায়। এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে ৫ উইকেটের কাঙ্ক্ষিত জয় শ্রীলঙ্কার জন্য।
১৬৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে শ্রীলঙ্কা। লঙ্কানদের ঘরের মাঠ পাল্লেকেলেতে খুব মামুলি এক স্কোর। প্রথম ওভার করেন পেসার তাসকিন আহমেদ। তাসকিন নিজের দ্বিতীয় ওভার করতে এসেই তুলে নেন দিমুথ করুনারত্নের উইকেট। ব্যাটের ফাঁক গলে সরাসরি বোল্ড এই ব্যাটার। লক্ষ্যমাত্রা যখন অল্প দলীয় ১৩ রানেই প্রতিপক্ষের প্রথম উইকেট ফেলতে পারা তখন ইতিবাচক।
টপ-অর্ডারের বাঁহাতি ব্যাটাররা (শান্ত বাদে) খারাপ করেছেন। কিন্তু বাঁহাতি বোলার শরিফুল ইসলামের ওভার দ্য উইকেট থেকে করা বলগুলো ব্যাট কেটে বের হয়ে যাচ্ছিল দারুণভাবে। সে বলে শট খেলাও মুশকিল হয়ে পড়েছিল ব্যাটারদের। সে থেকেই অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে মুশফিকুর রহিমের হাতে নিজেকে সঁপে দিলেন পাথুম নিশানকা। দ্রুতই দুই ওপেনিং ব্যাটারকে ফিরিয়ে বাংলাদেশ শিবিরে তখন উল্লাসধ্বনি।
নতুন ব্যাটার কুশাল মেন্ডিসের ব্যাটিংয়ে চাপ স্পষ্ট ছিল। রান তুলতে পারছিলেননা। ডট বল খেলছিলেন প্রচুর। নিজের খেলা প্রথম ১৮ বলে কোনো রান তোলেননি এই ব্যাটার। ১৯ বলে একটি সিঙ্গেল। ২০তম বলে একট চারের মার খেলেন। তবে ওপর্যন্তই। সাকিব আল হাসানের অসাধারণ এক ডেলিভারি সরাসরি স্টাম্প চিনে নেয়। বোল্ড হয়ে ফেরেন মেন্ডিস, ব্যক্তিগত পাঁচ রান করে। দলীয় রানটা তখন ৪৩।
বাংলাদেশ ৩৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়েছিল। লঙ্কানদের চেয়ে অতো খারাপ ছিল না। সে দিক থেকে শ্রীলঙ্কার এই দলীয় স্কোর ও উইকেটসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য আশা জাগানিয়া হিসেবে ধরা দিয়েছে তখন।
এরপরের গল্পটা ভিন্ন। সাদিরা সামারাবিক্রমা ও চারিথ আসালাঙ্কা। এই দুই ব্যাটার মিলে আস্তে-ধীরে, সহজাত ভঙ্গিতে ছোট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে থাকে। একসময় মনে হচ্ছিল, দুজন মিলেই খেলা শেষ করে দিবেন। তবে জুটি ভাঙেন শেখ মেহেদী হাসান। সামারাবিক্রমা জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসে মারতে গেলে, বল টার্ন নিয়ে মুশফিকের গ্লাভসে জায়গা নেয়। স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়ে যখন এই ব্যাটার ফিরছেন, তখন এই দুজনের ১১৯ বলে ৭৮ রানের জুটি ভেঙ্গে যায়। সামারাবিক্রমা ফেরেন ৭৭ বলে ৫৪ রান করে। দলীয় ১২১ রানে লঙ্কানরা নিজেদের চতুর্থ উইকেটের পতন দেখে।
তখনো ৪৪ রান প্রয়োজন ছিল। হাতে শ্রীলঙ্কার ৬ উইকেট। বাংলাদেশের দর্শকদের নির্ভার হওয়ার কোনো কারণ তো নেই। তবে এদিকে সাকিবের বলে এক কাণ্ড ঘটে। দলীয় ১২৮ রানের মাথায় নতুন ব্যাটার ধনঞ্জয়া ডি সিলভা কিছুটা স্টেপ আউট করে ফুল লেংথ ডেলিভারি খেলতে গিয়ে বোল্ড হন। বাংলাদেশ শিবিরে নতুন করে উল্লাস দেখা দেয়৷ মনে হচ্ছিল, তখনো কিছু আশা বাকি।
তবে চারিথ আসালাঙ্কার ব্যাট চলমান ছিল। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে এক প্রান্তে খেলে যাচ্ছিলেন নির্ভাবনায়। সাথে যোগ দিলেন অধিনায়ক দাসুন শানাকা। শানাকা থাকাকালীন নিজের অর্ধ-শতকও পূরণ করে নেন আসালাঙ্কা। অধিনায়ককে সাথে নিয়ে এশিয়া কাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ শেষ করেন তিনি। আসালাঙ্কা অপরাজিত ছিলেন ৯২ বলে ৬২ রানে। অন্যদিকে শানাকা অপরাজিত ছিলেন ২১ বলে ১৪ রান করে।
বাংলাদেশের বোলারদের পক্ষে, ২ উইকেট নিয়েছেন সাকিব আল হাসান। ১ টি করে উইকেট নিয়েছেন তাসকিন আহমেদ, মেহেদী হাসান মিরাজ ও শেখ মেহেদী হাসান।
টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ব্যাটাররা সেই সিদ্ধান্তের প্রতিদান দিতে পারেনি। নাজমুল হাসান শান্তর ইনিংসটাই ছিল বলার মতো। ১২২ বলে নিয়েছেন ৮৯ রান। পুরো দলের ব্যাটিংয়ে বলার মতো আর কোনো পারফরম্যান্স ছিল না। তৌহিদ হৃদয়ের সাথে মাঝে শান্তর জুটি ছিল আশা জাগানিয়া কিন্তু তা বড় হয়নি। এরপর বাকিরা ছিলেন আসা ও যাওয়ায় মধ্যে। এভাবেই ১৬৪ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ দল।
তানজিদ হাসান তামিমের অভিষেক ম্যাচ। একেবারেই রাঙাতে পারেননি। রানের খাতা খোলার আগেই ফিরতে হয়েছে। ২ বল খেলে শূন্য রানে মাহিশ থিকশানার বলে আউট হয়েছেন তিনি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই বাংলাদেশ দলের প্রথম উইকেটের পতন।
ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম চার ব্যাটার বাঁহাতি। যা নিয়ে চিন্তা ছিল, সেদিকেই পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার স্পিনের সামনে পড়তে হয়েছে। থিকশানা, ধনঞ্জয়া ডি সিলভাদের সামলাতে যে অসুবিধা হচ্ছিল, তাও স্পষ্ট একদমই। নাঈম শেখও পিচে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারলেননা। ২৩ বল খেলে ১৬ রান করে নিজের সাথে সংগ্রাম শেষে অপ্রয়োজনীয় শটে আউট হন।
অধিনায়ক সাকিব আল হাসান অফ স্টাম্পের বাইরের বল লেট শট খেলে আউট হলেন মাথিশা পাথিরানার বলে। একটি চার এসেছিল। ব্যক্তিগত ৫ রানে ফিরেছেন।
একপাশ আগলে পড়ে ছিলেন কেবল নাজমুল হাসান শান্ত। তৌহিদ হৃদয়কে নিয়ে ইনিংস গড়ার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। হৃদয় লঙ্কা লিগ খেলে এসেছেন কিছুদিন আগে। তাঁর কাছে প্রত্যাশা ছিল বেশি। দুজন মিলে ৫০ পেরোনো জুটিও গড়লেন। জুটি যখন ৫৯ রানে, তখন এক লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন হৃদয়। বোলিংয়ে ছিলেন দাসুন শানাকা। এই ডেলিভারিতে রিভিউ নিবেন, এমন মনেহয় নি। কিন্তু শানাকা সাথে সাথেই রিভিউ নিলেন। ফলও পেলেন। হৃদয় ফিরলেন মাত্র ২০ রানে।
এরপর মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে শান্ত চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু মুশফিকও ফিরলেন দলীয় ১২৭ রানে। সেসময় ৩৩ ওভার চলছে, বাংলাদেশ হারিয়েছে ৫ উইকেট। রান তোলার ক্ষেত্রে দলটির পরিশ্রম চোখে পড়ার মতো।
পরের ব্যাটাররাও আসা-যাওয়ার মিছিলে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেননি। মেহেদী হাসান মিরাজ ও শান্ত মিলে ভুল বোঝাবুঝিতে মিরাজ ফিরলেন এক বাজে রান-আউটের শিকার হয়ে। শেখ মেহেদীর থেকে দল যা আশা করেছিল, তার প্রতিদানও তিনি দিতে পারেননি। লেগ বিফোর হয়ে ফিরেছেন।
সেই আগলে রাখা শান্ত-ই ছিলেন শুধু মাঠ জুড়ে। তখনো প্রায় ১০ ওভার বাকি ছিল। শান্ত এবার ফিরলেন সেই থিকশানার বলে, যিনি কিনা ৮ ওভার করে মাত্র ১৯ রান দিয়ে তুললেন ২ উইকেট। অসাধারণ এক ক্যারম ডেলিভারিতে সরাসরি বোল্ড করে দিলেন শান্তকে। ফিরলেন ১২২ বলে ৮৯ রান করে। এরপর আর কোনো গল্প নেই। থাকার কথাও না। তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমানেরা একে একে ফিরলে, ১৬৪ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ দল। ওভার চলছিল তখন ৪২.৪।
শ্রীলঙ্কার বোলারদের পক্ষে, মাথিশা পাথিরানা ৪ উইকেট, মাহিশ থিকশানা ২ উইকেট নিয়েছেন। দুনিথ ওয়েলালাগে, দাসুন শানাকা ও ধনঞ্জয়া ডি সিলভা ১ টি করে উইকেট পেয়েছেন।
বাংলাদেশের এই ব্যাটিং ব্যর্থতার দিনে শ্রীলঙ্কার জন্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ ওভারে মাত্র ১৬৫ রান।