

সবুজে মোড়ানো চা বাগানের কোলে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে আছে, বহন করছে ঐতিহ্য। চা-বাগান আর পাহাড় টিলা ঘেরা দেশের অন্যতম নয়নাভিরাম এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামেই যেন সিলেটের সব সৌন্দর্যের সমারোহ। শুধুই কি দেশ, পুরো বিশ্বের অন্যতম সেরা স্টেডিয়ামের তালিকায়ও নিঃসন্দেহে জায়গা পাবে সিলেটের নাম। সিলেটি ভক্তদেরও বিন্দুমাত্রা উত্তেজনার অন্ত নেই, ভরপুর গ্যালারি পুরোটা সময় খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে আফগানদের ভয় ধরিয়ে দেয়। দর্শক উন্মাদনাকে পূর্ণতা দিতেই যেন শেষ মুহূর্তের চাপেও শরিফুলের ব্যাটে অসাধারণ চার! শরিফুল-হৃদয়ের উদযাপনের উজ্জ্বলতা সিলেটের ঐতিহাসিক সব জায়গার সারাংশ। শুদ্ধপ্রাণ মহামনীষী, মহাঋষি ও মহামুণিদের চরণ-স্পর্শে ধন্য, পুণ্যভূমি সিলেটের ঐতিহ্য গাঁথা। এবার এখানেই হাজার-হাজার দর্শক নিয়ে আফগানদের শাসন করছে সাকিব, তাসকিনরা।
লাক্কাতুরার চা বাগানে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন এই মাঠের চারপাশেই উঁচু-নীচু টিলায় জন্মে থাকা চা গাছ, চায়ের পাতার ঘ্রাণ, ধূলো-কাদা মাখা পথ; এক কথায় পুরো সিলেটেরই প্রতিনিধি এই মাঠ। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামটা দেখে আপনাকে মুগ্ধ হতেই হবে। মুগ্ধতা ছড়ানো এ মাঠের দর্শক উন্মাদনা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো মাঠের চেয়ে বেশিই হবে।
শহরের কোলাহলের বাইরে অপূর্ব সুন্দর চা বাগান, নানা ধরনের ছায়া বৃক্ষের কাছাকাছি বিশাল আয়তনের এই স্টেডিয়ামটি হওয়ায় ভালোই হয়েছে। স্টেডিয়ামে যারা খেলা দেখতে আসে তারা একই সাথে দু’টি জিনিস উপভোগ করতে পারে। অনেকটা ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো’। এখানে যেমন ছায়াবৃক্ষে ভরা চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় আবার একই সাথে কেউ চাইলে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে অথবা কোন একটি টিলার চূড়ায় বসেও খেলা দেখতে পারে। ক্রিকেটের সাথে হয়তো এক কাপ চা পান করার নেশায় আপনি বারবার আসতে চাইবেন এই জায়গায়।
বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টির দিনে ম্যাচ শুরুর আগ থেকেই কানায় পূর্ণ হতে শুরু করে ১৮৫০০ ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামটি। মাঠের বাইরে টিকিটের জন্য হাহাকার করতে থাকা দর্শকের সংখ্যাও ভেতরের চাইতে নেহাত কম নয়। রোদ-বৃষ্টির খেলা শেষে তখনও নরম বাতাস বইছে। হিমেল পরশ দিয়ে যাচ্ছে গ্যালারিকে। কত কত মুখ, অথচ আওয়াজ একটাই বাংলাদেশ। সন্ধের গায়ে বিকেল ঢলে পড়লেও সিলেটি দর্শকেরা ক্ষান্ত হন না।
ম্যাচের শেষদিকে গ্যালারিতে জ্বলে উঠে হাজার হাজার মোবাইল। যেন মেঘমুক্ত আকাশে ফুটে উঠেছে অসংখ্য তারা। গ্যালারি উপচে পড়া মানুষের মুখে তখনও শেষ হাসি ফোটেনি। উল্লাসের প্রস্তুতি চলছে মাত্র। প্রবাদই আছে, শেষ ভাল যার, সব ভাল তার। তবে শরিফুল ইসলামের কল্যাণে শেষটা যে বাংলাদেশের ভালোই হল। গ্যালারি ফের গর্জে ওঠে।
১৮ হাজার ৫০০ দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সিলেটের এই স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের বিশ্ব টি-টোয়েন্টির ৬টি ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হয়েছিল সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। সেই বছরের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচেও হেরেছিল বাংলাদেশ। এবার হচ্ছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দুই টি-টোয়েন্টি। প্রথমটাতেই রোমাঞ্চকর জয় পাওয়া বাংলাদেশ পেল এই মাঠের অভিষেক জয়।
এতো গেল সিলেট স্টেডিয়ামের গুণকীর্তন, এবার আসা যাক যাদের কারণে সিলেট বিশ্বখ্যাত। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাণ্ডারি হিসেবে সগৌরবে প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে আসছে পুণ্যভূমি সিলেট। জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী এ জেলারই কৃতী সন্তান। হযরত শাহজালাল (রঃ) ও হযরত শাহ পরান (রঃ) এর পবিত্র মাজার শরীফ সিলেট শহরকে করে রেখেছে আলোকিত। বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ লোকের তীর্থস্থান এই সিলেট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত এই শহরটি দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত।
সুরমা নদীর তীরবর্তী এই শহরটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। ক্বীন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘঁড়ি, চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি যেন সিলেটের ট্রেডমার্ক। সিলেট এর স্থানীয় ভাষা ‘‘সিলটি ভাষা’’র একটি বিশেষত্ব রয়েছে যা অন্য অঞ্চল থেকে পৃথক। এ ছাড়া নাগরী বর্ণমালা নামে সিলেটের নিজস্ব বর্ণমালাও রয়েছে। সিলেটকে নতুনভাবে সিএনজির শহরও বলা যায়, সবুজ রঙের এই গাড়িগুলোই সিলেটের একমাত্র গণপরিবহন। যেভাবে দাপিয়ে বেড়া শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে, তাসকিনের গতিকেও যেন হার মানায়।
পুণ্যভূমি সিলেটে এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। ১-০’তে এগিয়ে থাকা সাকিব আল হাসানের দল কাল নামবে ইতিহাস গড়তে…