

সিলেটের নয়নাভিরাম মাঠে ২০ ওভারের ক্রিকেটে এই প্রথম টাইগারদের সুখস্মৃতি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এই প্রথম সিলেটে জয়ের মুখ দেখল বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য ২ উইকেটের জয়ে নায়ক বনে গেলেন এদিন দুইজন; শামীম হোসেন ও তাওহিদ হৃদয়। দুজনেই রীতিমতো তান্ডব চালানেন ইনিংসের শেষ ওভারগুলোতে। ম্যাচের মোমেন্টাম নিজেদের প্রান্তে আনতে সবচেয়ে বেশি রান খরচ করান আজমতউল্লাহ ও ফজলহককে। ৪৩ বলে খেলা তাদের অনবদ্য ৭৩ রানের জুটিতে জয়ের পথটা সহজ হয়ে যায় টাইগারদের।
শেষ ৬ বলে জয়ের জন্য তাওহিদ হৃদয় ও মেহেদী হাসান মিরাজের সামনে ৬ বলে ৬ রানের সমীকরণ। করিম জানাতের করা ওভারের প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাঁকান মিরাজ। পরের বলে অবশ্য পুল করতে গিয়ে ক্যাচ আউটে বিদায় নেন মিরাজ। তাসকিন আহমেদও করলেন একই ভুল, ওয়াইড বল খেলতে গিয়ে হলেন কিপারের হাতে ক্যাচ।
সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি জিততে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১৫৫ রান। প্রথম পাওয়ার প্লের ৩৬ বলে বাংলাদেশ দুই উইকেট খুইয়ে জমা করে ৩৭ রান। দারুণ এক স্ট্রোক্সে বাউন্ডারি হাঁকানো রনি তালুকদার ফজলহক ফারুকির করা প্রথম ওভারের শেষ বলে হারিয়েছেন স্টাম্প। সোজা স্টাম্প বরাবর আসা বল ডিফেন্ড করতে ব্যর্থ রনি ৪ রানেই নিয়েছেন বিদায়। নাজমুল হোসেন শান্তকে অবশ্য দুর্ভাগা বলতে হবে। মুজিব-উর রহমানকে স্লগ সুইপে খেলতে গিয়ে ব্যাট ছোঁয়াতে পারেননি বলে। শান্তর হাতে আঘাত করে বল যায় স্টাম্পে। ব্যক্তিগত ১৪ রানে থামে শান্তর ইনিংস।
আবারও পুল খেলতে গিয়ে ভুল করলেন লিটন দাস। আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের বলে টপ এজ হয়ে লিটন ফিরলে ৩৯ রানে তৃতীয় উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ৭.২ ওভারে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে রান যখন ৪১ তখন ফের বৃষ্টি সিলেটে। মিনিট পাঁচেক পর বেরসিক বৃষ্টি থেমেও যায়। কভার সরিয়ে মাঠ শুকানোর কাজে ব্যস্ত গ্রাউন্ডসম্যানরা। এর মাঝেই অনফিল্ড আম্পায়াররা মাঠ পরিদর্শন করে গেছেন। দু’এক পশলা বৃষ্টি কিন্তু ম্যাচে ফেলতে পারেনি বড় কোনো প্রভাব। ৮ টা ৫০ মিনিটে ফের ব্যাটিংয়ে নামে সাকিব-হৃদয়।
বৃষ্টির কারণে ১৭ মিনিটের বিশ্রাম পাওয়া সাকিব আল হাসান এরপর এসেই আলো ছড়ালেন। দেখালেন ব্যাটিং তান্ডব। ফরিদ-রাশিদের পরের দুই ওভারে সাকিব-হৃদয় মিলে তুলে নিলেন ১৯ রান। কিন্তু সাকিব উড়িয়ে মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ধরা পরেন। ৬৪ রানে ৪ নম্বর উইকেট হারায় বাংলাদেশ। প্যাভিলিয়নে ফেরার আগে অধিনায়কের ব্যাট থেকে ১৭ বলে আসে ১৯ রান। এরপর তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে শামীম হোসেন পাটোয়ারীর অসাধারণ এক জুটি।
ইনিংসের ১৩তম ওভারে আজমতউল্লাহ ওমরজাই এই দুই তরুণ ব্যাটারের সামনে এসে খরচ করেন মোট ২১ রান। এই এক ওভারেই ম্যাচের মোমেন্টাম নিজেদের প্রান্তে ফের ঘুরিয়ে নিয়ে আসে বাংলাদেশ। ১৩তম ওভারেই দলীয় রান ১০০ তে পৌঁছায় বাংলাদেশের। শেষ ৭ ওভারে জয়ের জন্য দরকার হয় ৫৫ রানের। শামীম-হৃদয় বেশ দেখেশুনেই রাশিদ-মুজিবদের শেষ ওভারগুলো খেলছিলেন। কিন্তু ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে ওভার বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে সহজ এক ক্যাচ তুলেও নাজিবউল্লাহ জাদরানের কল্যাণে বেঁচে যান ২৪ রানে থাকা শামীম।
ইনিংসের ১৭তম ওভারে ফজলহক ফারুকিকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে দেন শামীম-হৃদয়। স্ট্রোক্সের ফুলঝুরি ছুটিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের পথে নিয়ে আসেন তারা।
টসের ঠিক আগে বৃষ্টিরা ক্ষান্ত যায়। মেঘেদের বুকভেদে ঠিকরে ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি রোদ। সিলেটের চিরচেনা এই রোদ-বৃষ্টির খেলা শেষে বাইশগজে বল হাতে তাসকিন, শরিফুলদের দাপট। টাইগার বোলারদের তান্ডবের সাথে সিলেটের কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারির গর্জনে দিশেহারা হয়ে উইকেটের মিছিল দেখায় আফগানিস্তান। মোহাম্মদ নবী কেবল ব্যতিক্রম, দাপুটে ব্যাটিংয়ে ফিফটি হাঁকিয়ে থাকেন অপরাজিত। শেষপর্যন্ত আফগানিস্তানের ইনিংস থামে ১৫৪ রানে।
ম্যাচ শুরুর আগ থেকেই কানায় পূর্ণ হতে শুরু করে ১৮৫০০ ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামটি। মাঠের বাইরে টিকিটের জন্য হাহাকার করতে থাকা দর্শকের সংখ্যাও ভেতরের চাইতে নেহাত কম নয়। টস জিতে আগে বোলিং নেওয়া বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ইনিংসের শুরুটা করেন নাসুম আহমেদকে দিয়ে। জাজাই আর গুরবাজ মিলে প্রথম দুই বলে নেন দুই সিঙ্গেল, বাকি ৪ বল ডট দিয়ে যান ঘরের ছেলে নাসুম। পরের ওভারে তাসকিন আহমেদ এসেই এনে দিতে চেয়েছিলেন ব্রেকথ্রু। তিনজন ফিল্ডার একত্রিত হলেন, দুজন উদযাপন শুরু করলেন কিন্তু ক্যাচ না হওয়ায় রনি তালুকদার বল করলেন উইকেটকিপারের গ্লাভসে থ্রো। কভার পয়েন্ট থেকে উল্টো দৌঁড়ে গিয়ে বল হাতে পান রনি তালুকদার, কিন্তু শরীর মাটিতে আগে পরে যাওয়ায় তিনি আর ধরে রাখতে পারেননি। এ যাত্রায় বেঁচে যান রহমানউল্লাহ গুরবাজ।
নিজের দ্বিতীয় ওভার করতে এসে নাসুম যেন হয়ে গেলেন ট্রেডমার্ক সাকিব আল হাসান; আগের বলে ছক্কা হজম করে পরের বলে উইকেট শিকার। ঠিক তেমনি নাসুমও ওভারের প্রথম বলে ৬ হাঁকানো হযরতউল্লাহ জাজাইকে পরের বলে বানালেন ক্যাচ আউট। ১০ বলে ৮ করে জাজাই ফিরে গেলে ভাঙে ১৬ রানের উদ্বোধনী জুটি। রীতিমতো ধুঁকতে থাকা গুরবাজ শেষপর্যন্ত ফিরলেন তাসকিনের বলেই। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত এক লো ক্যাচ লুফে নেন মিরাজ। ফেরার আগে ১১ বল খেলা গুরবাজের সংগ্রহে ১৬ রান।
ছক্কা হাঁকানোই যেন আফগান ব্যাটারদের বড় ভুল। সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যান শাস্তি, হারান নিজেদের মহামূল্যবান উইকেট। নাসুমের মতোই রূপ নিলেন শরিফুল ইসলাম। টপ এজে আগের বলে ৬ পাওয়া ইব্রাহিম জাদরান পরের বলে ব্যাট ছুঁইয়ে হয়েছেন উইকেটের পেছনে ক্যাচ। ৮ রানের বেশি করতে পারেননি ইব্রাহিম। এবারের বাংলাদেশ সফরে এসে টানা ৪ বার শরিফুলের হাতেই উইকেট হারালেন ইব্রাহিম জাদরান। পাওয়ার প্লের প্রথম ৬ ওভারে স্কোরবোর্ডে ৪০ রান করতেই আফগানদের নেই টপ অর্ডারের তিন ব্যাটার।
ইনিংসের ৮ম ওভারে নিজের প্রথম ওভার করতে এসেই অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তুলে নেন উইকেট। করিম জানাত এদিন খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সাকিবকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মিড অফে নাজমুল হাসান শান্তর হাতে হয়েছেন ক্যাচ। ভয়ংকর হয়ে উঠার আগেই নাজিবউল্লাহ জাদরানকে ফিরিয়ে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে আসল কাজটা করেন উইকেটকিপার লিটন দাস। গ্লাভস হাতে লিটনের আরও একটি তীক্ষ্ণ কাজ। এটি এত ভালভাবে করা হয়েছিল যে প্রথম দর্শনে কী ঘটেছিল তা বোঝা কঠিন। বল ব্যাট ছুঁয়ে প্রথমে আঘাত করে লিটনের প্যাডে, এরপর লাফিয়ে উঠা বলটিকে রীতিমতো এক, দুই পা এগিয়ে ক্যাচ নেন লিটন।
মোহাম্মদ নবী ও আজমতউল্লাহ ওমরজাই এরপর দেখান ৫৬ রানের ক্যামিও জুটি। সাকিব ভাঙেন এই জুটি। ১৮ বলে ৩৩ রানের ইনিংস খেলা ওমরজাই ছয় হাঁকান ৪ টি। শেষ ওভারে মুস্তাফিজকে ৬ হাঁকিয়ে মাত্র ৩৯ বলে পঞ্চাশ ছুয়েছেন নবী। আর তাতে আফগানিস্তানের রানও পৌঁছে যায় দেড়শ রানে। ইনিংসের পঞ্চম বলে রাশিদ খানকে ফেরাতে লং অনে দারুণ এক ক্যাচ লুফে নেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ৩ রানে বিদায় নেন আফগান অধিনায়ক।
৭ উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তান স্কোরবোর্ডে জমা করে ১৫৪ রান। বল হাতে সর্বোচ্চ ২ উইকেট সাকিব আল হাসানের। বাকি পাঁচ বোলার নিয়েছেন একটি করে উইকেট।