

কতটা আর লুকানো যায়। কষ্ট, সে তো বের হয়েই আসে কোনো না কোনোভাবে। নাজমুল হোসেন শান্ত। এই ক্রিকেটারকে নিয়ে কম কিছু হয়নি। মিডিয়া, দর্শক-সমর্থক– কত ধরনের আলোচনা আর সমালোচনার মধ্যে দিয়েই না যেতে হয়েছে তাকে। একদিন তো বলে বসলেন, “আমি এই কথাটি বলতে চাই না, কিন্তু খুবই সত্য কথা। আমি এখন প্রতিপক্ষের সাথে খেলি না, আমার মনে হয় আমি এখন পুরো দেশের বিপক্ষে খেলি।” — এ কথা বলার পরে ‘সরি’ও বলেছিলেন। সেই শান্ত নিজেকে বদলেছেন সময়ের সাথে। নিজের ও দলের প্রয়োজনে। চিন্তাভাবনা, চেষ্টা আর টেকনিকের অদল-বদল করেছেন। পেয়েছেন সাফল্য। এখনো পাচ্ছেন। শান্ত’র ব্যর্থ দিনগুলো একবারে হারিয়ে যাক, এইতো চাওয়া সকলের। শান্ত এখন গেয়ে যাক শুধু নতুনের গান।
খুব শুনেছেন কথাটি। বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড়, যার পিছনে বিসিবির অনেক বিনিয়োগ। এ কথা শুনলেই আপনার মন খুঁজে নেয় তাকে। আর কেউ তো নন, নাজমুল হোসেন শান্ত-ই হবেন। হ্যাঁ, তার পিছনে অনেক বেশি বিনিয়োগ ছিল বিসিবির। বলা হয়, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। বেশি কেনো হবে না! নাজমুল হোসেন শান্ত তেমন আশাই দেখিয়েছিলেন।
বয়সভিত্তিক দল থেকেই শুরু। বিসিবির নজর ছিল শান্তর দিকে। ২০১৬ এর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। সে বার বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। সে দলের সদস্য ছিলেন শান্ত। বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করে। মেহেদী হাসান মিরাজ টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন, শান্ত’র ব্যাটেও এসেছিল রান। সেরা দশ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ১০ নম্বরে ছিলেন তিনি। সংগ্রহ করেছিলেন ২৫৯ রান।
রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার ঘরোয়া ক্রিকেটে করেছেন প্রচুর রান। ২০১৭-১৮ সালের কথায় আসা যাক। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের সে আসরে ১৬ ম্যাচে ৭৪৯ রান করেছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। সাহসটা তাই তৈরি হওয়াই ছিল শান্তর। ব্যাটে রান করা, সেরা হওয়া।
সাহসের কথা বলা যায় আরো। শান্তর বয়স তখন ১৯। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দল যাবে নিউজিল্যান্ড সফরে। সেই সফরে দলের সাথে রাখা হয় তাকে। গিয়েছিলেন শিক্ষানবিশ হিসেবে। তবে বাংলাদেশ দলের ব্যাটারদের ইঞ্জুরি, শান্তকে সুযোগ তৈরি করে দেয়। ১৯ বছর বয়সেই তাই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট অভিষেকটা ঘটে তার। ওয়ানডে অভিষেকটা তার পরের বছর, ২০১৮ সালে। অভিষেকের পর থেকেই নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে দলের সঙ্গে ছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ভালো খেলেছেন, আবার খারাপ করেছেন। একাধিক খারাপ করেছেন, দর্শকেরা বিরক্ত হয়েছে। বাংলাদেশি সমর্থকদের ধৈর্য পরীক্ষা নিয়েছেন তিনি ভালোভাবেই। অশান্ত করে ছেড়েছেন বারংবার। শান্ত-কে কেন রাখতে হবে দলে? ‘লর্ড’– অসম্মানিত করে সেই ডাকটাও শান্ত’র কপালে জুড়ে দিয়েছে সমর্থকেরা। যেন কোনোভাবেই আর তাকে চাইছেনা তারা।
নির্বাচকরা? এই নির্বাচকরা চেষ্টা করে গেছেন। সমর্থকদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে একের পর এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন শান্তকে। যেন এক গড়ে তোলা পাত্র, যাকে কোনোভাবেই হারাতে দেওয়া যাবেনা। বিসিবি সভাপতিও নাকি একবার হতাশ হয়েছিলেন, জানালেন কিছুদিন আগে। শান্ত কি করছেন?
শান্তও চেষ্টা করে গেছেন। এটাই তো শুধু করা যায়। এর বেশি আসলে করার কি কিছু থাকে! বোধহয় না। সেই চেষ্টায় ফল আসা শুরু করেছে। আমুদে স্বরে বলা যায়, সোনার হাঁস ইদানীং ডিম দিচ্ছে। সমর্থকেরা ‘হালকা’ একটা হাসি দিয়ে সেই সোনার ডিমের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে মনে ভাবেন, যাক ভুল হয়নি– ২৫ বছরের এই ছেলের দম আছে।
ধীরে ধীরে ফিরে আসা
২০২০ সালে বিপিএলের আদলে হওয়া বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে শান্ত নিজের খোলস ছেড়ে বের হতে থাকেন। ব্যাট চালিয়ে খেলতে থাকেন। মনে হচ্ছিল, সময়ের সাথে নিজেকে কিছুটা বদলে নিয়েছেন। টি-টোয়েন্টিতে নাজমুল হোসেন শান্তর অভিষেক ২০১৯ সালে। অস্ট্রেলিয়াতে হওয়া শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দিকে ফেরা যাক। সেই বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং প্রশংসনীয় ছিল। অজি কন্ডিশনে ২৫,৯,৭১,২১ ও ৫৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। করেছিলেন ১৮০ রান। বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই বছরে অনুষ্ঠিত হওয়া বিপিএলের দিকে তাকাই। নাজমুল হোসেন শান্ত খেলেছেন নতুন দল সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে। সিলেট এবারের বিপিএলে হয়েছে রানার্স-আপ। শান্ত রেখেছেন দারুণ অবদান। শুধু ‘দারুণ’ বললে প্রকাশে কিছুটা কমতি থেকে যায়। অনেক বেশি দারুণ বলতে হয়। পত্রিকাগুলো লিখতে থাকে ‘পাঁচশোর বেশি রান করে টুর্নামেন্ট সেরা শান্ত’— জি হ্যাঁ। ৩৯.৬৯ গড়, ৪ টি হাফ-সেঞ্চুরিতে ৫১৬ রান করেন শান্ত। স্ট্রাইকরেট ছিল ১১৬.৭৪। বিপিএলের ইতিহাসে তিনি প্রথম বাংলাদেশি, যিনি পুরো টুর্নামেন্ট খেলে ৫০০ রান করার মাইলফলক অর্জন করেন।
এ বছর ইংল্যান্ডের সাথে সাদা বলের– দুই সংস্করণেই শান্ত নিজের সেরাটা দিয়েছেন। নিজেকে উজাড় করে দেওয়া বোধহয় একেই বলে। টি-টোয়েন্টির তিন ম্যাচে ৫১, ৪৬*, ৪৭* ছিল তার রান। ১২৭.৪৩ ছিল স্ট্রাইকরেট। মোট করেছেন ১৪৪ রান। ওয়ানডেতে তিন ম্যাচ সিরিজে ৫৮ ও ৫৩ রানের দু’টি ইনিংস ছিল তার।
গত মে মাসে আয়ারল্যান্ডে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলে বাংলাদেশ। সেই সিরিজেও সিরিজ-সেরার পুরস্কার ওঠে নাজমুল হোসেন শান্ত’র হাতে। তিন ম্যাচে সংগ্রহ করেন ১৯৬ রান। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেলেন ৯৩ বলে ১১৭ রানের ইনিংস। তৃতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটি উইকেটও তিনি অর্জন করে নেন। ফলে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় হতে কোনো সমস্যা হয়নি তার।
সদ্যই শেষ হয়েছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হওয়া একমাত্র টেস্ট। সেই টেস্টে রেকর্ড ৫৪৬ রানে প্রতিপক্ষকে হারিয়েছে বাংলাদেশ দল। নাজমুল হোসেন শান্ত কী করেছেন? তিনি দুই ইনিংসেই খেলেছেন সেঞ্চুরি। প্রথম ইনিংসে ১৪৬ রান ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৪ রান। দুই ইনিংস মিলিয়ে মোট করেছিলেন ২৭০ রান। আফগানরা দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছিল ২৬১ রান। আনন্দচিত্তে গণমাধ্যমে খবর রটল, শান্ত’র কাছেই ৯ রানে পরাজিত আফগানরা।
“শান্তর ইনিংস দেখলে মনে হয় কি যে, খেলাটা অনেক সহজ। নিজেরও মনে হয় ওভাবেই খেলি। কিন্তু আমি যে ধরনের ব্যাটসম্যান আমার ওভাবে খেলা কঠিন। শান্ত-লিটন দুজনের খেলা দেখতেই অনেক ভালো লাগে। একটা জিনিস যেটা ভালো, শান্ত খারাপ বলটা ছাড়ে না খারাপ বলটা বাউন্ডারি করে। শান্ত দুই ইনিংসে এই গরমে যেভাবে খেলছে, দুইটা একশ অনেক বড় অর্জন।”
– শান্ত’কে নিয়ে মমিনুল হক (তিনিও একমাত্র টেস্টে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন)।
শান্ত কী পরিবর্তন করেছেন? মমিনুল আরো জানিয়েছেন, শান্ত তার প্রসেস ঠিক রেখেছে। আত্মবিশ্বাসী ছিল। ধৈর্য ধরেছে নিজের প্রসেসের উপর। এই ব্যাপারগুলোই শান্তকে সাফল্য এনে দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ধৈর্য শান্ত অবশ্যই ধরেছেন। তা যেমন নিজের প্রসেসের উপর। নিজের মানসিকতার উপরেও। যত সমালোচনা তাকে নিতে হয়েছে, একসময় জানালেন; সমালোচনায় নিজের পরিবার কষ্ট পায়। সতীর্থরা সবসময় পাশে ছিলেন। পাশে ছিলেন বিসিবি ও কর্মকর্তারা। আর ছিলেন শান্ত নিজেই। নিজের পাশে নিজে থাকাটাই সবচেয়ে বড় শক্তি, যা শান্ত হয়তো স্বীকার করবেন।
তিন ফরম্যাটে শান্ত’র পরিসংখ্যান
নাজমুল হোসেন শান্ত এখন পর্যন্ত ২৪ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ২৩ ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ২৬.৭৪ গড়ে রান করেছেন ৬১৫। সর্বোচ্চ রান ১১৭, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। স্ট্রাইকরেট ৭৬.৭৮। একটি শতক ও তিনটি অর্ধ-শতক রয়েছে তার নামের পাশে। বোলিংয়ে অনিয়মিত শান্ত ওয়ানডেতে একটিই উইকেট নিয়েছেন, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে।
শান্ত ২৩ টি টেস্ট খেলেছেন। ব্যাট করেছেন ৪৪ ইনিংসে। ২৯.৮৪ গড়ে ১২৮৩ রান করেছেন। সর্বোচ্চ রান ১৬৩, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। চারটি শতক ও তিনটি অর্ধ-শতক রয়েছে তার নামের পাশে।
টেস্টের সমান ২৩ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন শান্ত। ২৩ ইনিংসে ব্যাট করে ২৮.৮৪ গড়ে ৫৪৮ রান তুলেছেন তিনি। সর্বোচ্চ রান ৭১, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ত্রিশোর্ধ রানের ইনিংস খেলেছেন পাঁচটি। তিনটি অর্ধ-শতক রয়েছে নামের পাশে। আন্তর্জাতিক বিশ ওভারের খেলায় তিনি চার মেরেছেন ৫২ টি, ছয় মেরেছেন ৬ টি।
আমরা এখন চাইলে নাজমুল হোসেন শান্ত-কে নিয়ে সকলের মতো গাইতে পারি ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’— কিন্তু না। আমরা সেই গানটা গাইব না। ফিরে আসাটাই বরং স্বাভাবিক। জীবনটা এমনই যে, এখানে ফিরে আসা এবং নিভে যাওয়া– দু’টি বিষয় পাশাপাশি চলতে থাকে। ফিরে আসলেই যে আর নিভে যাওয়া যাবেনা, তা নয়। ক্রিকেটে তো নয়ই। ক্রিকেটে ফেরা এবং নেভা, আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। বরং ফিরে আসাকে যত্ন করে আর লালন করে যে’জন– সেইজনের ফিরে আসা আনন্দদায়ক, দীর্ঘস্থায়ী ও মর্মের কাছাকাছি। আমরা চাই, আমাদের শান্ত ‘সেইজন’ হোক।
লিখেছেন, মঈন হাসান