

নাথান লায়নের যে ওভার খেলে ইংল্যান্ড দল ডিক্লেয়ার দেয়, সে ওভারে রান এসেছে ২০। জো রুট হাঁকান দুই ছয়। রবিনসনের এক চার। শেষ বলটাও রুট যেভাবে শরীর ছেড়ে ব্যাট চালিয়েছেন, তাতে সে বলেও কিছু বাউন্ডারি আসতে পারতো। এসেছে দুই রান। ৭৮ ওভার খেলে ৩৯৩ রানেই ইংল্যান্ড দল ইনিংস ঘোষণার সিদ্ধান্তে চলে যায়। হাতে তখনো ছিল দুই উইকেট। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে, ১৪ রানের সংগ্রহ ও বিনা উইকেটে অ্যাশেজের প্রথম দিন শেষ করে। পুরো দিনে ইংল্যান্ড দলের চরিত্র ছিল রুটের খেলা রিভার্স সুইপে ওভার বাউন্ডারি মারার মতো।
পিচ ও আবহাওয়া
দিনের শুরুতে জানা যায়, এজবাস্টনের আবহাওয়া ১৪ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে। ক্রিকেটের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়াই ছিল পুরো দিন। সম্প্রতি নটিংহ্যামে হওয়া এক হামলায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা ঘটেছে। যারা আবার ক্রিকেট খেলার সাথেও যুক্ত ছিল। যার ফলশ্রুতিতে, দুই দল মাঠে নামে কালো আর্ম-ব্যান্ড পরিহিত অবস্থায়।
সাধারণত এজবাস্টনের পিচ উভয় দলকেই সহযোগিতা করে। সার্ফেস খুব ভালো হওয়ায় বোলার এবং ব্যাটার উভয়ের জন্যই সুযোগ নিয়ে আসে। পেসাররা নতুন বলে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পায়। ব্যাটাররা উইকেটে থাকলে সুযোগ তাদের কাছেও আসে। পিচ যখন আস্তে আস্তে ভঙ্গুর হতে থাকে, ব্যাটাররা নিজেদের সুযোগ আরো বাড়িয়ে নিতে পারে। বলের সাথে ব্যাটের সংযোগ বাড়ে, মাঝ ব্যাটে খেলা যায় চাইলেই। হয়তো এই স্বাচ্ছন্দ্যের ভাবনা থেকেই টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করবার সিদ্ধান্ত নেয় বেন স্টোকসের দল।
দিনের শুরু ও শেষ
জ্যাক ক্রাউলি এবং বেন ডাকেট ওপেন করতে আসেন ইংল্যান্ডের হয়ে। ক্রাউলি ইনিংসের প্রথম বলেই বাউন্ডারি মেরে জানান দিলেন যেন, এসেছি ‘বাজবল’ নীতিতে। প্যাভিলিয়নে বসে অবিশ্বাস্য মুখশ্রী বানিয়ে পরক্ষণেই হাসিতে ভাসা মুখ দেখা গেল স্টোকসের। বলতে চাইলেন হয়তো, পরিকল্পনা তো এমনই, তাই বলে একদম প্রথম বলেই শুরু করে দিলে! ওভার প্রতি ৫ করে রান তোলা খুব সহজ, ক্রাউলি-ডাকেটের ব্যাটিং দেখে প্রথম তিন ওভার তাই মনে হলো। ৩.৫ ওভারে জশ হ্যাজেলউডের বলে কাট খেলতে গিয়ে বেন ডাকেট চলে গেলেন অ্যালেক্স ক্যারির গ্লাভসে। দলীয় ২২ রানে ইংল্যান্ডের প্রথম উইকেটের পতন ঘটে।
তবে ২২ রানে উইকেট পতন, তাতে স্টোকসরা বিচলিত হয় না। রান তুলতে থাকেন জ্যাক ক্রাউলি, সাথে অলি পপ। ৯ ওভারের মাথায় দলীয় সংগ্রহ চলে যায় ৪০ এর ঘরে। আর ততক্ষণে ইংলিশদের সামনে অজি দল পরিচয় করিয়ে দিয়েছে স্কট বোল্যান্ডকে। অর্ধ-শতকের কোটা ছাড়িয়ে ১৩ ওভারে ৬৬ রানের সংগ্রহ নিয়ে আসে ক্রাউলি এবং পোপ। রান রেটটা ঘুরতে থাকে ৫ এর ঘরে।
নাথান লায়নকে বোলিংয়ে আনা হয় দশম ওভারে। সাফল্য পেতে দেরি হয়নি। ১৮.২ ওভারে অলি পপকে বিদায় করে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটান লায়ন। ৩১(৪৪) রান করে যখন পপ বিদায় নিচ্ছেন, ততক্ষণে অর্ধ-শতক করে ফেলেছেন ক্রাউলি। অর্ধ-শতকের জন্য তাকে খেলতে হয়েছে মাত্র ৫৬ টি বল।
জো রুট কে সঙ্গী করে ক্রাউলি আবার আগাতে থাকেন। দলীয় শতকটা আসে ২১ তম ওভারে গিয়ে। লাঞ্চ বিরতির আগের ওভারটা স্কট বোল্যান্ডের দায়িত্বে তুলে দেন কামিন্স। বিরতিতে যাবার জন্য যখন শুধু এক বল বাকি, সে বলেই নিজের উইকেট বিলিয়ে দিলেন জ্যাক ক্রাউলি। গ্লাভসে লেগে বল চলে গেছে ক্যারির গ্লাভসে। ফিল্ড আম্পায়ার মারাইস এরাসমাস কি কারণে যেন দ্বিধায় ছিলেন, যে কারণে যেতে হলো থার্ড আম্পায়ারের কাছে। তিনি আর দেরি করলেননা। স্পষ্ট আউট দিয়ে দিলেন। দুই দল চলে গেল লাঞ্চ বিরতিতে আর ক্রাউলি একেবারে ড্রেসিংরুমে।
লাঞ্চের মধ্যে ৩ উইকেটের পতন অজিদের আরাম দিয়েছে বটে, তবে রানের চাকাটা ছিল সবসময় সচল।
লাঞ্চ বিরতির পর জো রুটের সাথে ব্যাটিংয়ে নামেন হ্যারি ব্রুক। নাথান লায়নের একের পর এক চেষ্টা রান কমাতে পারেনি ইংলিশদের। জো রুটের পঞ্চাশ হয়ে যায় ৫৬ বলে। দলীয় রান তখন ১৭৪। বিপত্তি লাগে ১৭৬ রানের মাথায়। আউট-সাইড এজ হয়ে ক্রিস লায়নের বল কোথায় যেন উঠে গেল, কিপার-ব্যাটার বল খুঁজতে থাকেন। সে বল উপর থেকে এসে ভেঙ্গে দিল হ্যারি ব্রুকের স্টাম্প। দুর্ভাগ্যজনক এক উইকেটের শিকার হলেন ব্রুক। ইংল্যান্ডের চতুর্থ উইকেটের পতন।
পতন যেন পতন নিয়ে আসে। হ্যাজেলউডের ফুলার লেংথ তবে হাফ-ভলি নয় ধরনের এক বলে অ্যাংগেল-ড্রাইভ করতে গিয়ে এজ হয়ে ফেরেন ক্যাপ্টেন স্টোকস। নিশ্চিত হওয়ার জন্য রিভিউ নিয়েও কোনো লাভ হয়নি। ৯ বল মোকাবিলা করে ১ রানের ব্যবধানে ২ উইকেট হারিয়ে বসে ইংল্যান্ড দল। স্কোর তখন ১৭৬/৫।
দ্রুত ২ উইকেট হারানো পর্যন্তই। এরপর বেয়ারস্টোকে সাথে নিয়ে রুটের পথচলা চলতে থাকে। বেয়ারস্টো যখন ফিফটি করে ফেলেছেন। রুট ছুটছেন তার শতকের পথে। রুটের সাথে ১২১ (১৪০) রানের জুটি ভাঙ্গে নাথান লায়নের চমৎকার ডেলিভারিতে। গুড লেংথের বল স্ট্রোক খেলতে গিয়ে বল মিস করে বসেন বেয়ারস্টো। অ্যালেক্স ক্যারির সহজ স্টাম্পিং আর ইংল্যান্ডের ৬ষ্ঠ উইকেটের পতন। বেয়ারস্টো ফেরেন ৭৮ (৭৮) রানে। দলীয় রান তখন ২৯৮। মঈন আলি উইকেটে এসে বেশিক্ষণ থিতু হতে পারেননি। আক্রমণাত্মক ব্যাট চালিয়ে দুই চার আর এক ছয়ে ১৮ রান করে লায়নের শিকার হন।
পরবর্তীতে স্টুয়ার্ট ব্রড, তিনি আউট হওয়ার পর, অলি রবিনসন- দুজনকে নিয়েই এক ফাঁকে নিজের ৩০-তম টেস্ট শতকের দেখা পান রুট। ১৪৫ বলে ১০০ করার গৌরব অর্জন করেন তিনি। যার প্রথম সেঞ্চুরিও ছিল অজিদের বিপক্ষেই।
এরমধ্যেই অনেকটা হঠাৎ করেই ইনিংস ঘোষণা করে বসে ইংল্যান্ড। জো রুটের অপরাজিত ১১৮ (১৫২) রানের সাথে অলি রবিনসন তখন মাঠে ছিলেন ১৭ (৩১) রান করে। ৩৯৩/৮, ৭৮ ওভার শেষে, এই স্কোরকার্ডে শেষ বেলায় অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটের আমন্ত্রণ জানানোই যেন ছিল পরিকল্পনা। ফেলা যায় কিনা কিছু দ্রুত উইকেট। সেই ইচ্ছা থেকে স্টুয়ার্ট ব্রড এবং অলি রবিনসন চেষ্টা করে গেলেন দুই দুই চার ওভার। ডেভিড ওয়ার্নার এবং উসমান খাজার সতর্ক ব্যাটিং ১৪ রানের সংগ্রহ দেয় অজিদের, পড়েনি কোনো উইকেট।
অ্যাশেজ সিরিজের, প্রথম টেস্টের প্রথম দিন এক স্মরণীয় সময় হয়েই থাকল। লাল বলে ইংল্যান্ডের নতুন ধরনের ক্রিকেট। দিনের বাকি, হাতে উইকেট নিয়েও ইনিংস ঘোষণা করা। অ্যাপ্রোচ আর অ্যাপ্লাই- দুটোতেই তাদের পরিকল্পনা খুব স্পষ্ট। এই পরিকল্পনা কিছুটা ঝুঁকির আবদার নিয়ে সামনে দেখা দিবে কিনা, তা জানা নেই। তবে এখন পর্যন্ত দেখতে খুব ভালো লাগছে। মনে পড়ে স্টোকসের ক্রিকেট নীতির কথা, এন্টারটেইনিং ক্রিকেট ফার্স্ট, রেজাল্ট সেকেন্ড!