

এনামুল হক জুনিয়রের দেশে থাকার উপলক্ষ হয় জাতীয় ক্রিকেট লিগ কিংবা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। এর বাইরে যে সুযোগটা থাকে তা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। সেখানেও এবার নিলামে ছিলেন অবিক্রীত। অন্যবার নিলামের বাইরে দল পেলেও এবার আর তা হয়নি। খেলা ছাড়া এনামুলের দেশ থাকা হয় খুব কমই, বেশিরভাগ সময় থাকেন যুক্তরাজ্যে, তাই সিলেট ও ঢাকার পর তার প্রিয় শহর এখন লন্ডন।
বিপিএলে দল না পেলেও লন্ডনে বসে শুভকামনা জানাতে ভুলেননি এনামুল। শুভকামনা জানানোর পাশাপাশি, সুদূর লন্ডনে বসে এবারের আসরটা মিস করবেন তাও উল্লেখ্য করেন। তার সাথে এও যোগ করেন যে, এখনো বিপিএলের খেলার সামর্থ্য রাখেন তিনি। বিপিএল শুরুর আগেরদিন নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুক আইডিতে এনামুল লিখেন, ‘Definitely will miss Bpl this year. although still capable of playing this tournament. Good luck all the teams and players.’
সেই সামর্থ্যের ছাপ এনামুল রেখেছিলেন বিপিএলের প্রথম দুই আসরেই। চিটাগং কিংসের হয়ে প্রথম আসরে ৯ ম্যাচে ৬.২৬ ইকোনমিতে শিকার করেন ১৩ উইকেট। এরপর দ্বিতীয় আসরেও সাফল্যের সেই ধারা অব্যাহত রাখেন এনামুল। এই আসরেও আরও আঁটসাঁট বোলিংয়ে ৬.২০ ইকোনমিতে ১৫ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৮টি উইকেট। বাংলাদেশীদের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ।

বিপিএলের দুই বিপিএলের ধারাবাহিকভাবে দুর্দান্ত বোলিংয়ে নজর কাড়েন নির্বাচকদের, ফিরেন জাতীয় দলে। ফিরে এসে ২০১৩ সালে খেলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি টেস্ট, উইকেট নেন ৩টি। সেই সফর থেকে ফিরে এসে পড়ে যান ইনজুরিতে, ঘরোয়া ক্রিকেটে হয়ে যান অনিয়মিত। ইনজুরি কাটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরলেও ফেরা হয়নি আর জাতীয় দলে।
এদিকে এক বছর বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালে আবারও মাঠে ফিরে বিপিএল, সেই আসরে অবশ্য দল পাননি এনামুল। নিলামে ছিলেন অবিক্রীত, পরে আর কেউ আগ্রহ দেখায়নি। বিপিএলের প্রথম দুই আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এনামুলের তৃতীয় আসরে দল না পাওয়ার পিছনে কারণ ছিল বিপিএলের এক বছরের বিরতি। সে আসরটা ঠিক সময়ে হলে, নিলামেই হয়তো দল পেতেন তিনি। বিপিএলের অধারাবাহিক আয়োজন আর ইনজুরির সাথে লড়াই করতে থাকা দীর্ঘ একটা সময় বিপিএলে দল বিহীন ছিলেন এনামুল।
সে আসরে দল না পাওয়া নিয়ে এনামুল বলেন, ‘সেই এক বছরের বিরতিটাই একটা বড় ব্যাপার ছিল, আসলে আমার ক্যারিয়ারটা এভাবে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ছিল তাই, ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের কারণে দীর্ঘ একটা বিরতির কারণেই টেস্ট ক্রিকেটে ক্যারিয়ারটাও লম্বা হয়নি। বিপিএলের তৃতীয় আসর সময় মতো না হওয়া আর কিছুটা ইনজুরির কারণে তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলতে পারিনি। তাই সেসময় দল পাইনি হয়তো। তবে আমি এখনো বিপিএলে খেলার মতো সামর্থ্য রাখি।’
বিপিএলের প্রথম আসরে চিটাগং কিংসের এনামুল হক জুনিয়রকে দলে নেওয়ার পিছনে ছিল পোর্ট সিটি ক্রিকেট লিগ ২০১০ এর আসর। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় অনুষ্ঠিত সেই টি২০ টুর্নামেন্টেও বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন সিলেটের এই বা হাতি স্পিনার। সেই টুর্নামেন্টে যে দলের হয়ে খেলেছিলেন সেই দলের অনেকেই ছিলেন কিংস টিম ম্যানেজমেন্টে। কোচ হিসেবেও ছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন।
চট্রগ্রামের হয়ে বিপিএলের প্রথম দুই আসর মাতানো এনামুল, ২০১৯-২০ সালে আবারও বিপিএলে ফিরেন সেই চট্রগ্রামের হয়েই। ২০১৯ সালে বিপিএলের নিলাম থেকেই তাকে দলে নেয় চট্রগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের মালিক পক্ষ। তবে দীর্ঘ বিরতির পর দল পাওয়াটাও সুখকর হয়নি এনামুলের জন্য, স্বদেশী নাসুম আহমেদ দুর্দান্ত ছন্দে থাকায় চ্যালেঞ্জার্স খেলায়নি তাকে কোনো ম্যাচে।
বছর পেরিয়ে আবারও বিপিএল নিলাম এলো, আবারও অবিক্রীত এনামুল। তবে সেবার নিলামের বাইরে চ্যালেঞ্জার্সও দলে নেয় তাকে। তবে কোনো ম্যাচ না খেলিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করে চ্যালেঞ্জার্স।
এবার যখন বিপিএলের নিলাম এলো, আশায় ছিলেন দল পাবেন। সাদা বলের ক্রিকেটে দারুণ একটি বছর কাটিয়ে এসেছেন গেল মৌসুমে, রূপগঞ্জ টাইগার্সের হয়ে দারুণ বোলিং করছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। মোহামেডানের বিপক্ষে পাঁচ উইকেটে নিয়েছিলেন তিনি।

তাই একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন দল পাওয়ার ব্যাপারে, যেমনটা বলেছিলেন এনামুল, ‘আসলে সাদা বলের ক্রিকেট দেখে যদি ফ্র্যাঞ্চাইজি গুলো দল করে থাকে, তাহলে দল না পাওয়ার কথা নয়। কারণ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ভাল বোলিং করেছি। এমনকি মোহামেডানের বিপক্ষে ৫ উইকেটেও পেয়েছিলাম। তাই এবার দল পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম।’
বিপিএলের প্রথম দুই আসর ছিল জাঁকজমকপূর্ণ, দেশ-বিদেশের সব তারকারা খেলতেন এই লিগে। এরপর যতদিন গড়িয়েছে বিপিএল হারিয়েছে তার জৌলুস। বিপিএলের মান নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা, আছে আয়োজন নিয়ে বিতর্ক। তবে এসব তর্ক-বিতর্কে পেছনে রেখে বিপিএলকে এনামুল দেখছেন দেশের একমাত্র বড় টুর্নামেন্ট হিসেবে। বিশ্বের সাথে তুলনা করলেও থাকবে অন্যতম সেরার তালিকায়। এনামুল কাছে এটা হচ্ছে নিজেকে প্রমাণ করার দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম, তরুণদের পাশাপাশি জাতীয় দলের বাইরে থাকা ক্রিকেটারদেরও নিজেকে প্রমাণ করে জাতীয় দলে ফেরার সুবর্ণ সুযোগ এই বিপিএল।
এনামুল বলছিলেন, ‘আসলে বিপিএল হচ্ছে দেশের সেরা একটি টুর্নামেন্ট। যেখানে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ থাকে। এখানে দেশের সেরা ক্রিকেটারদের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক সেরা ক্রিকেটাররা আসে খেলতে। দেশের তরুণ ক্রিকেটাররা বিদেশি ক্রিকেটারদের সাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, যেটা তাদের ভবিষ্যতে কাজে দিবে। বিপিএল সরাসরি সম্প্রচারও করা হয়, দেশের মানুষের চোখ থাকে বিপিএল। অন্যান্য টুর্নামেন্টের চাইতে সবাই বিপিএল খুঁজ খবর রাখে বেশি। দেশের ক্রিকেট নীতি নির্ধারকদেরও আলাদা নজর থাকে। তাই নিজেকে প্রমাণ করার এটাই সেরা মঞ্চ।’
এনামুলের বিপিএল ক্যারিয়ার ২৮ ম্যাচের বেশি দীর্ঘ না হলেও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের অন্যতম সেরা স্পিনার তিনি। উইকেট সংখ্যায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার উপরে আছেন কেবল বর্তমান নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক। বছর দুইয়েক আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে স্পর্শ করেছেন ৫০০ উইকেটের মাইলফলক। পরিবারকে সময় দিতে এবছর অবশ্যই এক ম্যাচের বেশি খেলা হয়নি তার৷ ২৪তম জাতীয় ক্রিকেট লিগ শুরুর আগে থেকেই তিনি স্বপরিবারে ছিলেন ইংল্যান্ডে। ফিরে এসে সিলেটে খেলেন এক ম্যাচ। সেই ম্যাচে সিলেটের হয়ে খেলতে নেমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৫তম পাঁচ উইকেটের দেখা পান এই বা হাতি।
বছর ছয়েক আগে পেয়েছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩১তম পাঁচ উইকেটের দেখা, দ্বিতীয় ইনিংসে আবারও ৫ উইকেটে বত্রিশে পৌঁছে যান এনামুল। সেদিনই জানিয়েছিলেন ফিটনেস আর পারফরম্যান্স ধরে রেখে আর বছর পাঁচেক খেলতে চান। ফিটনেসে বরাবরই ভাল এনামুল, সাথে পারফরম্যান্সটাও আছে। তাই খেলাটাও চালিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। তবে তিনি যে সেই কবে বলছিলেন, ‘আর বছর পাঁচেক খেলতে চান’ তার কী হবে? সেই বছর পাঁচ তো পেরিয়ে গেছে কত আগে!

এমন প্রশ্নের সহজ জবাব এনামুলের কাছেই ছিল, সেই প্রশ্নের উত্তরে এনামুল জানিয়ে দিলেন, ‘বছর দুয়েক এক যে করোনায় গেছে তার কি খবর আছে! (হাসি)’ ‘করোনায় চলে যাওয়া সময়টা আগের পাঁচের সাথে যোগ-বিয়োগ করে দিলেই তো হিসাবটা মিলে যায়।’
কবে থামছেন এনামুল সেটা না হয় অজানাই থাকল, তবে বর্তমানে তরুণদের ভীড়ে নিজেকে মেলে ধরবেন কিভাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর জানা যাক। সেখানেও এনামুলের শক্তি ফিটনেস ও পারফরম্যান্স। যে ফিটনেস আছে তাতে তিনি আরও বছর পাঁচেক খেলতে পারবেন অনায়াসে, সাথে পারফরম্যান্সটা থাকলে তো কোনো কথা নেই। সেই খেলা চালিয়ে যাওয়ার কারণটাও তো জানা দরকার।
সেসবের উত্তর দিয়েছেন এনামুল, ‘আসলে জাতীয় দলে ফিরতে পারব কি পারব না সেটা জানি না। তবে লক্ষ্য থাকবে জাতীয় দলে ফেরার। ফিরতে না পারলেও কোনো আক্ষেপ থাকবে। তবে সিলেটের হয়ে জাতীয় লিগের শিরোপা জিতেই অবসরে যেতে চাই। সেটা হোক একাদশে থেকে অথবা দলে থেকে। অবসরে যাওয়ার আগে সিলেটের হয়ে শিরোপা জিততে চাই।’
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আর জাতীয় ক্রিকেট লিগের বাইরের সময়টা এনামুলের কাটে ইংল্যান্ডে। সেখানে গ্রীষ্ম কাটে মাইনর কাউন্টি খেলে আর শীত যায় কোচিং করিয়ে। অবসরের পর বিলেতে পাড়ি জমাবেন কিনা এমন প্রশ্ন তাই উঁকিঝুঁকি দেয় মনে। ঘনঘন ইংল্যান্ডে যাতায়াত করলেও এনামুল শিকড়টা গড়তে চান নিজ বাসভূমেই। অবসরের পর এনামুল থাকতে চান বাংলাদেশে, কাজ করতে চান দেশের তরুণদের নিয়ে।
এনামুল বলেন, ‘ইংল্যান্ডে বেশি আসা-যাওয়া করলেও, এখানে স্থায়ী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই। অবসরের পর দেশেই থাকব, দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে হলেও কাজ করব।’