বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন বদলেছে তিলকারত্নের

বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন বদলেছে তিলকারত্নের
Vinkmag ad

শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য, ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। হাসান তিলকারত্নে তার সময়কার অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটার। ৮৩ টেস্টে ৪২ এর বেশি গড়, ২৫২ প্রথম শ্রেণিতে গড়টা যখন ৫০ ছুঁইছুঁই। খেলেছেন ২০০ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে।

সমৃদ্ধ খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কোচ, ম্যানেজার নানা ভূমিকায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সাথেই আছেন। বর্তমানে দেশটির নারী দলের প্রধান কোচ। এশিয়া কাপ খেলতে বাংলাদেশে এখন লঙ্কান নারীরা। তার ফাঁকে ‘ক্রিকেট৯৭’ কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন নানা বিষিয়ে।

ক্রিকেট৯৭: নারী ক্রিকেটের সাথে কাজ করাটা কতটা উপভোগ করছেন?

তিলকারত্নে: এটা চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু খুব উপভোগ করছি। গত ৬-৮ মাস আমরা অনেক কাজ করেছি। আশা করি সেটারই প্রতিফলন হয়তো আগামী কয়েকদিনে দেখতে পাবো। খুব বেশি রিসোর্চ হয়তো আমাদের নেই। কিন্তু এসব নিয়েই আমি আশাবাদী। আমি নিজেও উপভোগ করছি।

ক্রিকেট৯৭: শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পর এবার নারী ক্রিকেটে কাজ করছেন। কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং?

তিলকারত্নে: নারী ক্রিকেটটাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। কারণ মানুষ আসলে রাতারাতি সাফল্য চায়। কিন্তু এটাতো এভাবে আসলে হয় না। আপনাকে নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে, নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে, টেকনিক্যালি ও টেকটিক্যালি এডভান্স হতে হবে। নারী ক্রিকেটে এসবের সমন্বয় করা চ্যালেঞ্জিং। সব মিলিয়ে এই জায়গাটাও আমি উপভোগ করছি।

ক্রিকেট৯৭: সম্প্রতি এশিয়া কাপ জেতা শ্রীলঙ্কা পুরুষ দলের ঘুরে দাঁড়ানোকে কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন?

তিলকারত্নে: গর্ব করে বলতেই হয় দারুণ কামব্যাক করেছে। যেভাবে তারা খেলেছে এবং সাফল্য পেয়েছে এতে আমাদের গর্ব করা উচিৎ। ৮ মাস পেছনে ফিরে গেলেও চিত্রটা এমন ছিল না। কত কথাই হচ্ছিল। আমার মনে হয় ড্রেসিং রুমে এটা নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। দক্ষতার দিক থেকে তারা কখনোই পিছিয়ে ছিল না। ব্যাপারটা হয়তো মানসিকভাবে তাদের পিছিয়ে দিচ্ছিল। এখন তারা আবার জিততে শুরু করেছে, পরিস্থিতিটা সামলে নেওয়া শিখেছে। তারা এখন দল হিসেবে খেলতেছে। একে অপরকে ভালো বুঝতে শিখছে, দুঃসময়ে সমর্থন জুগাচ্ছে। বিশ্বকাপেও এটা ধরে রাখবে আর এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইটা চালিয়ে যাবে প্রত্যাশা করছি।

ক্রিকেট৯৭: বিশ্বকাপে এই দল নিয়ে প্রত্যাশা?

তিলকারত্নে: তারা একসাথে খেলছে, একসাথে উপভোগ করছে। তারা এখন নিজেদের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা ভালোই বুঝে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের বর্তমান আত্মবিশ্বাসী চিত্রটাকে বড় করে দেখছি। বিশ্বকাপে ভালো কিছু প্রত্যাশাও করছি।

ক্রিকেট৯৭: আপনার ছেলেরা তিনজনই ক্রিকেট খেলছে। সফল সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে ছেলেদের কি পরামর্শ দেন?

তিলকারত্নে: আমার ছেলেরা খেলছে, জমজ ছেলে দুটো এখন ২৬ বছর বয়সী। আমার আরেক ছেলের বয়স ১৭, সে অনূর্ধ্ব-১৭ দলের অধিনায়ক। তারা সবাই খেলার প্রতি দারুণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, নিবেদিত। ভালোভাবে প্র্যাকটিস করছে। আর যেটা জিজ্ঞেস করলেন তাদের জন্য পরামর্শ বা উপদেশ…আমি বলে দিয়েছি তোমাদের নিজস্ব পরিচয়ে এগোতে হবে। কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা আসলে নেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য। তারা কঠোর পরিশ্রম করছে, আমি বিশ্বাস করি তারা একদিন তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। আমি আসলে সবসময় তাদের এসব নিয়ে বলিও না…(হাসি)। বুঝেনই তো, বেশি বলার ফল খুব ভালো হয় না আবার।

ক্রিকেট৯৭: ক্যারিয়ার শুরু করেছেন উইকেট রক্ষক ব্যাটার হিসেবে। ছাড়লেন কেন?

তিলকারত্নে: আমি শুরু থেকেই উইকেট কিপিং করছিলাম। অর্জুনা রানাতুঙ্গা আমাকে উইকেট কিপার বানিয়েছে। কারণ সে চাইছিল দলে একটা ভারসাম্য আসুক। তবে একটা সময় সে নিজেই চেয়েছে আমি যেন শুধু ব্যাটার হিসেবে খেলি। এরপর আমাদের বিশেষজ্ঞ উইকেট কিপার ছিল তারাই সেটা টেনে নিয়েছে। তারা নিশ্চিতভাবেই আমার চেয়ে ভালো ছিল (হাসি)।

ক্রিকেট৯৭: দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকানো প্রথম শ্রীলঙ্কান ব্যাটার আপনি। ঐ সেঞ্চুরির মহাত্ম অনেক, খানিক অভিজ্ঞতা যদি বলতেন…

তিলকারত্নে: (হাসি) যখন আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলাম তখন বার্তা এলো যে কেবল হোটেল আর মাঠেই থাকতে হবে। ঐ সময়টায় আমার একটাই কাজ হল যে ব্যাকফুটে উন্নতি করা। এটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার টেকনিকে উন্নতি করাটা বেশ কঠিন কাজই মনে হচ্ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেঞ্চুরি হাঁকানো যেন আমার কাছে স্বপ্ন সত্য হওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে এলো।

ক্রিকেট৯৭: এলপিএলে কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। যে ফরম্যাট (টি-টোয়েন্টি) কখনো খেলেনইনি। অভিজ্ঞতা কেমন?

তিলকারত্নে: খেলাটার উন্নতি হচ্ছে খুব দ্রুত। এসব পরিবর্তনের সাথে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে কোচ হিসেবে। খেলোয়াড়দের জন্যও একই ব্যাপার। কারণ একটা সময় শুধু টেস্ট আর ওয়ানডে ছিল আর এখন তো টেস্ট, ওয়ানডের সাথে টি-টোয়েন্টি একটা আন্তর্জাতিক ফরম্যাটই। আবার টি-টেনও স্বীকৃত ক্রিকেটে রূপ নিচ্ছে। এর ফলে কি হল বিভিন্ন ঘরানার ক্রিকেটার আসা শুরু করেছে, একেক জনের একেক দিকের দক্ষতা। এসবকে এক সাথে সমন্বয় করতে আমাদের মতো কোচদেরও মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এর সাথে আপনাকে নিজের উন্নতিটা নিজেকেই করতে হবে।

ক্রিকেট৯৭: মানিয়ে নেওয়া চ্যালেঞ্জিং?

তিলকারত্নে: এটা চ্যালেঞ্জিং তো অবশ্যই। কারণ ক্রিকেটীয় ব্যাপার স্যাপারের বাইরেও ভাষাগত ভিন্নতা, সংস্কৃতিগত ভিন্নতাও থাকে। তবে সেটাও বাধা না, সবাই দলীয় পরিবেশে ঢুকে গেলে আমরা কিন্তু এক ভাষাতেই কথা বলি। তবে সবচেয়ে বড় চাপটা সামলায় আসলে লজিস্টিকদের। কিন্তু আমাদের দিক থেকে চিন্তা করলে আসলে চ্যালেঞ্জের চেয়ে মজাটাই বেশি। একে অপরের সাথে পরিচিত হই, ভিন্ন ভিন্ন জায়গার সংস্কৃতি বিনিময় হয়। সবমিলিয়ে উপভোগ্য।

ক্রিকেট৯৭: এসব ফরম্যাট আসায় অনেকের ধারণা টেস্ট ক্রিকেট ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে…

তিলকারত্নে: আমার সেটা মনে হয় না। কারণ পুরো পৃথিবীটাই বদলাচ্ছে। ব্যাপারগুলো যে শুধু ক্রিকেটে ঘটছে তা না। অন্যান্য সেক্টরে যেভাবে আমরা মানিয়ে গেছি এখানেও আমাদের করণীয় একটাই, মানিয়ে নিতে হবে। খেলার ধরণ, আবেদন দ্রুতই বদলাচ্ছে। ক্রিকেটে আলাদা আলদা ভক্ত সমর্থক আছে। কেউ টেস্ট পছন্দ করে, কেউ ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি। আপনি দেখবে কোনো ফরম্যাটের খেলাই কিন্তু অচল না। নিজ নিজ ঘরানার খেলা যে যার মতো ঠিকই দেখছে। আর টেস্টের যে আলাদা আবেদন সেটা কিন্তু হারানোর নয়। এটা ক্রিকেট খেলার সৌন্দর্যের বড় উপকরণ হয়েই থাকবে।

ক্রিকেট৯৭: টেস্ট বাঁচাতে আইসিসি যা করছে যথেষ্ট?

তিলকারত্নে: আমি মনে করি আইসিসি অন্য টুর্নামেন্টগুলো আয়োজন করা উচিৎ স্পন্সর বা তাদের আর্থিক যে সমর্থন দরকার সেটার জন্য। কারণ আপনাকেতো অস্তিত্বও টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই টেস্টের বাইরে অন্য টুর্নামেন্টগুলো আইসিসি আর্থিক যোগানের জন্য আয়োজন করুক। টিভি স্বত্ব, দর্শকদের ব্যাপার সহ অনেক কিছুই থাকে। এসব তো ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টগুলোতেই থাকে। আর সেটাই কিন্তু হচ্ছে, সে দিক থেকে আইসিসি যা করছে সেটাই সঠিক পন্থা। টেস্ট নিয়ে তাদের ভাবনার জায়গাটা কিন্তু ঠিকই আছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ তারই অংশ, খেলাকে তারা আকর্ষণীয় করছে।

ক্রিকেট৯৭: ২০০৮ সালে আপনি শ্রীলঙ্কার উন্নতি প্রসঙ্গে বলেছেন বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ের মতো দুর্বল দলের সাথে খেলে লাভ কি? এখন কি মনে হয়?

তিলকারত্নে: বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। তাদের উন্নতি, অবকাঠামো, কমিটমেন্ট দেখতে ভালো লাগে। যুব বিশ্বকাপ জেতাটা নিশ্চিতভাবে উন্নতি বোঝা যায়। তারা শ্রীলঙ্কাতে গিয়ে শ্রীলঙ্কাকে টেস্ট হারালো। তাদের উন্নতি সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে। সুতরাং বলাই যায় অন্তত সেই বাংলাদেশ আর নেই।

ক্রিকেট৯৭: একজন দুর্দান্ত টেস্ট ব্যাটার হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাটারদের উন্নতিতে পরামর্শ?

তিলকারত্নে: নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যন্ডকে হারানো টেস্টে দুর্দান্ত ব্যাপার। এটার আলাদা মহাত্ম আছে কারণ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারানো এতো সহজ কাজ না। এটার পুরোটাই হচ্ছে নিজেকে উন্নতি করা, ঝুঁকি নেওয়া, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেকে এগিয়ে দেওয়া। যদি আপনি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চান তবে একটা না একটা সময় সাফল্য আসবেই। বাংলাদেশ উন্নতি করছে, ভালো মানের কিছু ক্রিকেটার উঠে আসছে।

ক্রিকেট৯৭: সাম্প্রতিক সময়টা ভালো যাচ্ছে না বাংলাদেশের…

তিলকারত্নে: এটা হতেই পারে। সিনিয়রদের সময় শেষ, তাদের অবসরে যেতে হয়। ঐ সময়টা নতুনদের জন্য একটা কঠিন সময় হাল ধরার। নতুনভাবে গড়ে তোলা যেকোনো জায়গাতেই কঠিন কাজ। আর এখানে বোর্ডের একটা চাওয়া থাকে, ভক্ত সমর্থকদের প্রত্যাশা থাকে। যে কারণে তাদের সতেজ থাকার সুযোগ করে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিতে হবে। ফলাফল আজ বললাম কাল চলে আসবে না।

আমাদেরও সময়টা খারাপ গিয়েছিল ২০১৬ সালের দিকে। যখন আমাদের শীর্ষ তারকা ক্রিকেটার সাঙ্গাকারা, মাহেলা, দিলশানরা অবসরে গিয়েছে। আমরা তিন ফরম্যাটেই ধপ করে খারাপ করা শুরু করলাম। কত সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে দলকে। তবে বোর্ড আস্থা হারায়নি। তাদের সময় দিয়েছে, তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগানোর পথ দেখিয়েছে। তবে সব কিছু হয়েছে ধীরে ধীরে। কারোন জ্ঞানটা সমৃদ্ধ হবে আপনি যত বেশি খেলবেন তত।

ক্রিকেট৯৭: ঢাকা লিগে বেশ কয়েক মৌসুম খেলেছেন। এখনকার সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কতটা এগোলো?

তিলকারত্নে: ঘরোয়া ক্রিকেটেও বাংলাদেশ উন্নতি করছে। আমি ঢাকা লিগে আমি ব্রাদার্সের হয়ে খেলেছি, দুই-তিন মৌসুম খেলেছি মোহামেডানের হয়ে। তখনকার সাথে তূলনা করলে বলতেই হয় এখন সব দিক দিয়েই উন্নতি হচ্ছে। অনেক তরুণকে দেখছি উঠে আসছে। সুযোগ সুবিধাও তো বাড়ছে। এখন ঢাকা লিগের বাইরেও কিছু টুর্নামেন্ট হচ্ছে। আর বিপিএল তো সহজেই ভালোমানের ক্রিকেটার তুলে আনতে পারে অন্তত সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের জন্য।

সিলেট থেকে নাজমুল হাসান তারেক

Read Previous

লোকাল ক্রিকেটেও এমন উইকেট দেখেনি বাংলাদেশ কোচ

Read Next

রুশোর সেঞ্চুরিতে উড়ে গেল ভারত

Total
1
Share