

‘ছেলেরা বলছে মেয়েরা পারবেনা, এটা যদি কোনো মেয়ে তার মাথায় গেঁথে নেয় তবে আসলেই কখনো পারবে না। তাই অন্যের কথায় বসে না থেকে নিজের চেষ্টা করে যাওয়াটাই শ্রেয়।’
উপরের কথাটা এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন মালয়েশিয়া নারী ক্রিকেট দলের ব্যাটার ইলশা হান্টার। মালয়েশিয়ায় জন্ম, তবে বাবার পেশাগত কারণে থাকেন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানেই ক্রিকেটের সাথে সন্ধি, প্রেমে পড়া। ২০১৫ বিশ্বকাপ তাকে ক্রিকেটার বানিয়ে দিয়েছে। ১৪ বছর বয়সে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেক।
এশিয়া কাপ খেলতে বর্তমানে আছেন সিলেটে। ‘ক্রিকেট৯৭’ কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানালেন নিজের পড়াশোনা, অস্ট্রেলিয়ায় থেকে মালয়েশিয়া জাতীয় দলে খেলা, স্টিভ স্মিথে মুগ্ধ হওয়া, রেচেল হেইন্সকে অনুসরণ করা সহ নানা বিষয়ে।
ক্রিকেট৯৭: ক্রিকেটে আসার গল্পটা?
ইলশা হান্টার: আমার বয়স তখন ১০ বছর, আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকাতে ২০১৫ বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ হয়েছে। সবুজ মাঠ, ক্রিকেট বলের উন্মাদনা আমাকে মোহে ফেলে। এভাবেই আসলে ক্রিকেটের প্রেমে ভালোভাবে মজেছিলাম।
ক্রিকেট৯৭: একটা গল্প শোনা যায়, আপনার স্কুলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলতো। মেয়ে বলে তাদের সাথে মিশিতেন না…
ইলশা হান্টার: হ্যাঁ আমি সিডনিতে তখন কেবল প্রাইমারিতে পড়ছিলাম। আমাদের ক্লাসের কিছু ছেলে প্লাস্টিক ব্যাট দিয়ে ক্রিকে খেলছিল। কিন্তু আমি মেয়ে হওয়াতে তাদের সাথে সেভাবে কখনোই কথা বলতাম না। কিন্তু লাঞ্চের সময় তারা খেলতো ব্যাট-বল দিয়ে এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করতো।
ক্রিকেট৯৭: থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়, খেলেন মালয়েশিয়ার হয়ে। সবকিছু ম্যানেজ করা কঠিন না?
ইলশা হান্টার : আমি অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনা করি, আবার সেখানে খেলিও। এখন যখন মালয়েশিয়ার হয়ে খেলা শুরু করেছি তখন কাজটা আরও কঠিন, নিজের পড়াশোনা ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে সময় দেওয়া। কিন্তু হ্যাঁ আমি মানিয়ে নিচ্ছি।
ক্রিকেট৯৭: অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, খেলেন। নিশ্চয়ই তাদের তারকা ক্রিকেটারদের সান্নিধ্য পেয়েছেন?
ইলশা হান্টার: আমি যখন অস্ট্রেলিয়াতে খেলি তখন অ্যালিসা হিলি, অ্যাশলে গার্ডনারের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেয়েছি। রাজ্য দলের সাথে উইমেন বিগ ব্যাশ লিগের সময়টায় তাদের কাছাকাছি যাওয়ার দারুণ সুযোগ পেয়েছি। তাদের বিপক্ষে খেলে অনেক কিছু শিখতে পারছি।
ক্রিকেট৯৭: কোনো বলার মতো স্মৃতি?
ইলশা হান্টার: হ্যাঁ একটা দারুণ স্মৃতি আছে। আমি কাভারে ফিল্ডিং করছিলাম। অ্যাশলে গার্ডনার ব্যাট করছিল, একটা শটে বল আমার ডান পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এতো জোরে যাওয়া বল আমি কোনোভাবে আমার হাতে আটকে ফেলি। এতে আমি যেমন আশ্চর্য হয়েছি, অ্যাশলেও। সে আমাকে বলল দ্যাটস গুড।
ক্রিকেট৯৭: ছেলেদের ক্রিকেটেই মালয়েশিয়া এখনো প্রতিষ্ঠিত না। সেখানে নারী দল এশিয়া কাপ খেলছে। কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
ইলশা হান্টার: অবশ্যই, মালয়েশিয়ার মেয়েরা দারুণ উন্নতি করছে। এ জন্য কটোর পরিশ্রমও করতে হচ্ছে। যেখানে পুরুষ ক্রিকেট এখনো একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। সেখানে মেয়েরা এখন এশিয়া কাপও খেলছে। এটা অবশ্যই বড় ইতিবাচক ব্যাপার। হংকংকে হারিয়ে বাছাই পর্ব উতরানোর যাত্রাটা সহজ ছিল না।
ক্রিকেট৯৭: মালয়েশিয়া ক্রিকেটকে কোথায় দেখতে চান?
ইলশা হান্টার: দল হিসেবে, দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া আরও আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে এটাই চাওয়া। আমার দেশে উচ্চ থেকে উচ্চতর হবে, বিশ্বজুড়ে মালয়েশিয়া ক্রিকেটের একটা স্বীকৃতি থাকবে।
ক্রিকেট৯৭: শুনেছি সুযোগ পেলে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেন…
ইলশা হান্টার: হ্যাঁ এখনো এটা আলোচনাধীন। আমি নিজেও এখনো তরুণ। আমি বিশ্বাস করি আমার অনেক সুযোগ আসা এখনো বাকি। খুব বেশি কিছু ভাবছিনা, ফোকাসটা নিজের উপর। সময়েরটা সময়ে আসাই বাকি। ক্যারিয়ারটা অনেক ভালো জায়গায় দেখতে চাই।
ক্রিকেট৯৭: অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া দুই জায়গাতেই খেলার সুবাধে দুই জায়গার কন্ডিশনের পার্থক্য ঠিকই টের পান। যদি একটু বলতেন…
ইলশা হান্টার: বেশ ভালো পার্থক্যই আছে। যখন আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে মালয়েশিয়ায় খেলতে আসি তখন সেটা আরও ভালোভাবে টের পাই। ওখানকার উইকেট স্টিকি থাকে, বলের দিকে তুখোড় মনযোগী হতে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় যখন বলে সুইং আর মুভমেন্ট থাকে সেখানে মালয়েশিয়া বা উপমহাদেশে স্লো আর টার্নিং। আমার জন্য দুই জায়গায় চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু এটাই ক্রিকেটের ধর্ম। কন্ডিশনকে নিজের বশে আনতে হবে, খেলতে হবে।
ক্রিকেট৯৭: এশিয়া কাপে খেলার কারণে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের মতো দলের সাথে খেলার সুযোগ হচ্ছে। বড় দলগুলোর সাথে খেলাটা কতটা রোমাঞ্চের?
ইলশা হান্টার: অনেক বেশি রোমাঞ্চের। কারণ আমি এদের খেলা টিভিতে দেখতাম আর এখন তাদের সাথেই খেলছি। কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে তারা অসাধারণ ক্রিকেটটা খেলে। পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দেখা, চলন বলন, আচরণ থেকেও কত কিছু শেখার আছে। সেসব দেখছি আর নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করছি।
ক্রিকেট৯৭: কোনো তারকা ক্রিকেটারের সাথে কথা হয়েছে?
ইলশা হান্টার: হ্যাঁ, ভারতীয় কিছু ক্রিকেটারের সাথে কথা হয়েছে। তারা দারুণ সমর্থন দেয়। মায়া, মেঘনা এদের সাথে কথা হয়েছে। বেশ বিনয়ীও বলতে হয়, খুব কাছের কেউ যেন এমন করে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আমাদের সাথে।
ক্রিকেট৯৭: ভারতের সাথে ম্যাচে বৃষ্টির কারণে অপরাজিত থেকেছেন, ৫ বলের বেশি খেলার সুযোগ হয়নি। নিশ্চয়ই হতাশ?
ইলশা হান্টার: আমি খুব হতাশই হয়েছিলাম। যখন বৃষ্টির কারণে খেলা আর মাঠে গড়ালো না। আমি অধীর অপেক্ষায় ছিলাম ভারতীয় সব বোলারকে খেলার জন্য। সেটা আর হল না…
ক্রিকেট৯৭: ক্রিকেটে কাকে আদর্শ মনে করেন?
ইলশা হান্টার: আমি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটার রেচেল হেইন্সের বড়সড় ভক্ত। যেভাবে সে খেলে তা মুগ্ধ করে আমাকে। মাঠের বাইরেও সে অনুসরণের জন্য দারুণ একজন। তার ব্যাটিং টেকনিক আমি খুব উপভোগ করি, আমি পছন্দ করি।
ক্রিকেট৯৭: পুরুষ ক্রিকেটে আপনার ভালো লাগা?
ইলশা হান্টার: স্টিভ স্মিথকে আমি পছন্দ করি, অনুসরণ করি। মাঠে সে যেভাবে নিজেকে ম্যানেজ করে, ব্যাটিংয়ের সময় তার মানসিকতা, শরীরি ভাষা সবই অনুপ্রেরণা দেয়। খুব সহজাতভাবে সবকিছু করে সে। যেন এটা করা কোনো বিষয়ই না।
আমার সাথে এখনো দেখা হয়নি, সে সুযোগ পাইনি। সে যতটা ব্যস্ত তাতে সেই সৌভাগ্য এখনো হয়নি, হয়তো কোনো একদিন দেখা হয়েও যেতে পারে।
ক্রিকেট৯৭: ব্যাটিংয়ে আপনার শক্তির জায়গা?
ইলশা হান্টার: আমার শক্তির জায়গা হয়তো দ্রুত বল পড়তে পারা। আমি বলের প্রতি মনযোগটা ভালো রাখতে পারি বলে বিশ্বাস করি।
ক্রিকেট৯৭: আপনার বাবা-মা অনেক সমর্থন দেয় আপনাকে ক্রিকেট খেলার জন্য। যখন বিদেশে খেলতে যান তারা দেখতে আসে?
ইলশা হান্টার: হ্যাঁ হ্যাঁ, তারা আসে। আমি যখন মালয়েশিয়ায় খেলি, বেশিরভাগ সময়ই আমার মা আসে খেলা দেখতে, আমাকে সমর্থন দিতে। অন্যান্য দেশেও যায় মাঝে মাঝে। বাবা অস্ট্রেলিয়াতে প্রচুর সময় দেয় আমাকে।
ক্রিকেট৯৭: আপনি মালয়েশিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলের অধিনায়কও। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে কেমন উন্নতি দেখছেন?
ইলশা হান্টার: প্রচুর কিশোরীরা উঠে আসছে। এটা দেখতে খুব ভালো লাগছে। আমার বিশ্বাস তারা একদিন বড় কিছু করে দেখাবে। মালয়েশিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হিসেবে আমি কাছ থেকে দেখতে পারছি তৃণমূলে কতটা কাজ হচ্ছে। ভালো কিছুর অপেক্ষা।
ক্রিকেট৯৭: মালয়েশিয়া অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বকাপ খেলবে এমনটা আশা করেন?
ইলশা হান্টার: অবশ্যই, আমি খুব আশাবাদী নিকট ভবিষ্যতেই মালয়েশিয়া বিশ্বকাপ খেলবে। সে দিকে নজর দিয়েই ওখানকার ক্রিকেট এগোচ্ছে।