

চলতি বছর নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নারী বিশ্বকাপে হৃদয় ছোঁয়া এক দৃশ্যের জন্ম দেন পাকিস্তান নারী দলের তারকা বিসমাহ মারুফ। এক বছরের কম বয়সী কন্যা সন্তানকে নিজের সাথে রেখে একটা বিশ্ব আসর খেলে ফেলেছেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে বিসমাহর মাঠে ঢোকার ছবি নেট দুনিয়ায় বেশ আলোড়ন ফেলে, ভারত কিংবদন্তী শচীন টেন্ডুলকার করেছেন টুইট। প্রতিপক্ষ ভারত নারী দলের ক্রিকেটাররাও সকল ভেদাভেদ ভুলে কোলে নিয়েছেন ছোট্ট শিশুকে, আদর মাখা ছবিগুলো ঐ সময় দারুণ আলোড়ন ফেলে।
নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব ক্রিকেটে নারীদের জন্য বিসমাহর এই গল্প অনুপ্রেরণার। যে পথে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডও (পিসিবি) গড়েছে অনন্য নজির। প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে বিসমাহকে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কমনওয়েলথ গেমসে শুরুতে বাচ্চাকে অনুমোদন না দিলে পিসিবিই কঠোর অবস্থানে গিয়ে বিষয়টা সুরাহা করেছে।
তবে পাকিস্তান নারী দলের অধিনায়কের আগেই বাংলাদেশের এক নারী ক্রিকেটার এমন কিছুর সাথে অভ্যস্ত। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মেয়ে সন্তানকে নিয়ে খেলে চলেছেন বাংলাদেশ নারী দলের শুরুর দিকের ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জেসি। এত দিন ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার, উপস্থাপক, আম্পায়ার, কোচ সহ নানা ভূমিকায় নিজেকে জড়িয়েছেন।
তবে ক্রিকেটটা এখনো উপভোগ করেন, সাধ্যের মধ্যে পারফরম্যান্সেও বজায় রাখছেন ধারাবাহিকতা। তবে বিয়ে করার পর থেকে তার জন্য জাতীয় দলের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান জেসি। টাইগ্রেস জার্সিতে ২০১৩ সালে খেলেছেন সর্বশেষ। সন্তান জন্ম দিয়ে জাতীয় দলের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটেও ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন এই অফ স্পিনার।
সম্প্রতি সিলেটে শেষ হওয়া নারী জাতীয় লিগে (টি-টোয়েন্টি সংস্করণ) মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে খেলেছেন রংপুর বিভাগের হয়ে। ৭ ম্যাচে নেন ৯ উইকেট। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সর্বশেষ আসরে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ৬ ম্যাচে হাত ঘুরিয়ে নেন ৫ উইকেট।
৩২ ছুঁইছুঁই বয়সের জেসি ‘ক্রিকেট৯৭’ কে জানালেন সন্তানকে সাথে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে খেলার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে,
‘একটুতো চ্যালেঞ্জিংই। কারণ খেলার সময় নিজেকে ম্যানেজ করতে হয় অনুশীলন, ম্যাচের সাথে বাচ্চাকে সামলানো। লম্বা সময় ওর সাথে থাকা হয় না, আমি মাঠে ও দেখা যাচ্ছে ড্রেসিং রুমে বসে আছে। একটু চ্যালেঞ্জিং, তবে অভ্যাস হয়ে গেছে।’
‘ওর যখন তিন মাস বয়স তখন থেকেই আসলে ড্রেসিং রুমে থেকে থেকে অভ্যস্ত। তো এ জিনিসগুলো এখন বুঝে যেহেতু বয়স পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। সে জানে কখন মাঠে যাওয়া যাবে কখন যাওয়া যাবে না। অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম একটু কঠিন ছিল, সবাই একটু অন্যভাবে দেখতো। এমনকি এখনো অন্যভাবে অনেকেই দেখে।’
এক বাচ্চার মা হওয়াতে পারফরম্যান্স যথাযথ মূল্যায়ণ হয় না উল্লেখ করে যোগ করেন, ‘এই টুর্নামেন্টে আমি খুবই ভালো খেলেছি। ব্যাটিং, বোলিং ফিল্ডিং সবকিছুই ভালো হয়েছে । তারপরও একটা কথা শোনা যায় যে ওর তো বাচ্চা হয়ে গেছে খেলতেছে এখনো। অনেকে আবার এটাও বলে কেন অন্যদের জন্য আমি জায়গা ছেড়ে দিচ্ছি না? এই ব্যাপারটা কষ্ট দেয় যে আমার খেলা ছাড়াটা পারফরম্যান্স দিয়ে মূল্যায়ণ না করে আমার বাচ্চা হয়ে গেছে সেটা দিয়ে করা হচ্ছে।’
যে বিসমাহ মারুফের গল্প দিয়ে শুরু করেছি সেই বিসমাহ মারুফ কি জেসির অনুপ্রেরণা? এমন প্রশ্ন করতেই জানা গেলো ভিন্ন কিছু। বিয়ে করার কারণে দল থেকে বাদ পড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের পরিচিত এই মুখ।
শোনা যাক জেসির কন্ঠেই, ‘অনুপ্রেরণার দিক থেকে বলবো আমার ব্যাপারটা ওকে (বিসমাহ) অনুপ্রাণিত করা উচিৎ। কারণ ও যখন বাংলাদেশে আসে ২০১৮ সালে, কক্সবাজারে একটা টুর্নামেন্ট হল সে আমার মেয়ের ব্যাপারটা দেখেছে। অনেক আদর করেছে, সবাই আদর করে। ও তখন দেখেছে আমি বাচ্চাকে নিয়ে খেলছি, সব জায়গায় ঘুরতেছি। আর ওরটাতো (বিসমাহ মা হয়েছেন ২০২১ সালের আগস্টে) বেশি দিন হয়নি।’
‘পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড দারুণ সমর্থন করেছে। আমাদের ক্রিকেট বোর্ড হয়তোবা সেভাবে সমর্থন দেয়নি। এমনকি বাচ্চা তো পরের কথা বিয়ে করার পরপরই আমি জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ি। কারণ কি? বিয়ে হয়েছে তাই। তখন আমি জাতীয় দলের নিয়মিত ক্রিকেটার। শুধু বিয়ে করেছি বলে আমাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় কোচ ছিল।’
এক বাচ্চার মা হওয়ার কারণে সতীর্থ অন্য ক্রিকেটারের চেয়ে ভালো পারফর্ম করে ঘরোয়া ক্রিকেটেও বাহবাটা পাচ্ছেন না এই অফ স্পিনার।
জেসির বর্ণনায়, ‘একটা ম্যাচের কথাই বলি, আমি ও আরেকজন জুনিয়র ভালো ব্যাটিং করলাম। তুলনামূলকভাবে রানের দিক থেকে আমিই এগিয়ে ছিলাম। আমরা দুজন যখন ব্যাটিং করে বের হয়ে আসছি তখন একজন সিনিয়র কোচ, বিসিবির অফিশিয়ালই ধরেন ওকে বাহবা দিচ্ছে আমার সামনেই ‘গুড ব্যাটিং, গুড ব্যাটিং’ অথচ ওর থেকে আমিই ভালো ব্যাটিংটা করে আসলাম।’
‘অনেক ম্যাচেই দলের সেরা ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংয় আমিই করলাম কিন্তু অন্যদের যে বাহবা দেওয়া হয় সেটা আমি পাচ্ছি না। মানে তাদের কাছে ব্যাপারটা এমন যে আরেহ ও তো এক বাচ্চার মা হয়ে গেছে। এক বাচ্চার মা মানে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে এরকম একটা ভাবনা আরকি।’
এত সব তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও কেন ক্রিকেট খেলাটা টেনে নিচ্ছেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে তার উত্তর, ‘ক্রিকেট উপভোগ করি দেখেই খেলে যাচ্ছি। দেখেন আমি কিন্তু আম্পায়ারিংও করি। না খেললে এই জাতীয় লিগেও আমিও আম্পায়ারিং করতে পারতাম। আমার যে সহকর্মীরা আছে, একসাথে আম্পায়ারিং কোর্স করেছি তারা বলেছেও। আমি উত্তর দিয়েছি যে আম্পায়ারিংয়ের জন্য তো সারাজীবনই পড়ে আছে। চাইলে ভবিষ্যতে ম্যাচ অফিশিয়াল, কোচ হতে পারবো। ওটার কোনো বয়সীমা নাই। সুতরাং খেলাটা যতদিন খেলা যায় কেন খেলবো না?’
বিয়ে এবং বাচ্চা নেওয়া নারী ক্রিকেটারদের জন্য কতটা ভয়ের, শঙ্কার তা নিজের পরের বক্তব্যেই তুলে ধরলেন জেসি, ‘আমাদের জাতীয় দলেও আছে ২-৩ জন যারা বিয়ে করেছে। কিন্তু বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে…অনেকের বয়সও (বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত) পার হয়ে যাচ্ছে, ৩০ এর বেশি। কিন্তু বাচ্চা নিচ্ছে না। কারণ তাদের একটাই ভয় বাচ্চা নিলে তারা চলতে পারবে না, বাংলাদেশ দলে খেলা কঠিন হয়ে যাবে।’
অথচ ইনজুরির উদাহরণ টেনে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মাঠে ফিরে ভালো কিছু করা খুব কঠিন কিছু বলে মনে করেন না এই নারী ক্রিকেটার।
তার ভাষায়, ‘বাচ্চা হলে…যদি সিজারও হয়। খুব বেশি হলে তিন মাস লাগে ঠিক হতে, আরও বেশি যদি ধরি তাহলে ৬ মাস, ৮ মাস। কিন্তু খেলোয়াড়েরা যখন চোটে পড়ে, হাঁটুতে সার্জারি হয় বা অন্য কোথাও সার্জারি হয় তাদেরও তো পুরোপুরি ফিট হতে তিন মাস, ছয় মাস সময় লাগে। সেখান থেকে সেরে উঠে যদি কামব্যাক করা যায় তাহলে বাচ্চা হওয়ার পর তিন মাসের মাঝে সব ঠিক করে কামব্যাক করা যাবে না কেন?’
‘আপনি বিসমাহর কথাই ধরুন, বাচ্চা হওয়ার পর এমন কোনো আমূল পরিবর্তন তো হয় নাই। বিশ্বকাপে গিয়ে ভালো পারফর্ম করলো। বাচ্চা হওয়া একজন মেয়ের জন্য গর্বের ব্যাপার। বাচ্চা হওয়ার পর তাকে সম্মান না দিয়ে বরং এটাকেই তার ত্রুটি হিসেবে ধরা হচ্ছে।’