বাজে মন্তব্য পাশ কাটিয়ে সজীব জিতলেন ‘বেস্ট অলরাউন্ডার অ্যাওয়ার্ড’

বাজে মন্তব্য পাশ কাটিয়ে সজীব জিতলেন 'বেস্ট অলরাউন্ডার অ্যাওয়ার্ড'

বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রতিটি ক্রিকেটারের শুরুর গল্পটা হয়তো একই রকম। ক্রিকেট যাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার। বছর দশেক আগেও ক্রিকেট যে পেশা হতে পারে এই দেশে সেটা ভাবা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোণা। সময়ের বিবর্তনে প্রেক্ষাপট পাল্টেছে, স্কুল ব্যাগের পাশাপাশি সন্তানের কাঁধে ক্রিকেট কিট তুলে দিয়ে সাকিব-তামিমদের উত্তরসূরি বানানোর স্বপ্ন দেখে বাবা-মায়েরা।

সজীব মিয়ার কাহিনীটা আর অন্য ৮-১০ জনের মতোই। শুরুতে পরিবারের প্রবল আপত্তি। পরে কিছুটা ব্যর্থতা সঙ্গী হলেও পাশে দাঁড়ায় পরিবারই। তবে মাঝের সময়টাই হয়তো তাকে নিয়ে আলাদা করে বলতে কিংবা লিখতে উৎসাহী করেছে।

ওহ, এখনো তো বলাই হয়নি কে এই সজীব!

গতরাতে রাজধানীর বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবে সর্বশেষ ঢাকা প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে সেরা পারফর্মারদের পুরষ্কৃত করা হয়। ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) এই আয়োজনে দেখা মেলে সজীবের।

ব্যাটে-বলে দারুণ পারফর্ম করে জিতেছেন দ্বিতীয় বিভাগে সেরা অলরাউন্ডারের পুরষ্কার। গাজী টায়ার্স ক্রিকেট একাডেমির হয়ে তার ব্যাটে এসেছে ৪৩০ রান, অফ স্পিনে নামের পাশে উইকেট ২৭ টি।

পুরষ্কার হিসেবে সজীব পেয়েছেন একটি ভালো মানের ব্যাট। যা গ্রহণ করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছ থেকে।

কে এই সজীব সেটা জানতে গিয়েই এই প্রতিবেদকের সাথে মিনিট পাঁচেকের আলাপ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে উঠে আসা তরুণ অলরাউন্ডার ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। যে কারণে পরিবার না চাইলেও নিজের জমানো অর্থের সাথে লুকিয়ে বড় ভাইয়ের টাকা যোগ করে ভর্তি হন স্থানীয় ক্রিকেট একাডেমিতে।

তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে কোচ শামিম সব কিছু মওকুফ করে দেন। বিনা বেতনে কোচিং করানোর পাশাপাশি ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম ছাড়াও ব্যক্তিগত খরচও বহন করেন। সজীব ধীরে ধীরে ভালো খেলা শুরু করলে পরিবারও সমর্থন দেয়। ততদিনে অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে খেলে ফেলেন।

কিন্তু সাফল্যের পথে যে শুধু ফুল থাকে না, থাকে কিছু কাটাও। সজীবের জন্য সেই কাটা হয়ে আসে ২০১৮ সালে যুব দলের ক্যাম্প থেকে বাদ পড়া। বাদ না পড়লে হয়তো তার নামটাও থাকতো ২০২০ সালে আকবর আলির নেতৃত্বাধীন যুব বিশ্বকাপ জয়ী বাংলাদেশ দলের স্কোয়াডে। মাঝে ঢাকা প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগে খেলে ফেলেন এই তরুণ।

কিন্তু যুব দলের ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে হতাশ হয়েছেন। সাফল্য দেখে বুকে নিতে থাকা পরিবার আবারও ব্যর্থতায় পিছু হটে। কাছের লোকরা নেতিবাচক কথা বলা শুরু করে। নিজের উপর বাড়তে থাকা চাপে পিষ্ট হয়ে ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এবার বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ালো তার আপন বড় ভাই।

এ নিয়ে সজীব মিয়া বলেন, ‘সংগ্রামের মুহূর্ত আসে ২০১৮ সালের শেষের দিকে। যখন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্যাম্প থেকে আমি বাদ পড়ি। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাইনি। আর এতে আমার পরিবার, কোচ ও এলাকায় যারা সমর্থন দিত তারাও হতাশ হয়ে যায়। কাছের মানুষদের অনেকেই বাজে মন্তব্য করেছে। যে সময় মনে হচ্ছিল না ক্রিকেটটা চালিয়ে নিতে পারবো।’

‘তারপরেও মনে হয়েছে যে চেষ্টা করি যেহেতু এতোদিন ক্রিকেটই খেলেছি। যেহেতু ক্রিকেটের জন্য পড়াশোনা ও অন্যান্য জিনিস ত্যাগ করেছি। ২০১৮ থেকে ২০১৯ এই সময়টা খুবই বাজে গিয়েছে। ঐ সময়ে অনেকটা এমন হয়েছিল যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি ক্রিকেট খেলবো না।’

‘এতো মানুষের মন্তব্য, নিজের উপর একটা চাপ তৈরি হচ্ছিল। ঐ সময়টায় আবার আমার নিজের আপন ভাই পাশে দাঁড়ায়। উনি আমাকে বলে তুই ক্রিকেট খেল, আর কিচ্ছু চিন্তা করিস না, ভাই আছি। ভাইয়ের ঐ অনুপ্রেরণা থেকে আসলে নিজেকে আবার নতুন করে ব্যাক করাই যে আমার আসলে কিছু করার আছে। এরপর ফিরে আসি, আর এ বছরতো ভালো পারফর্মও করলাম।’

বড় ভাইকে না বলে নেওয়া টাকা দিয়ে ক্রিকেটে যাত্রা করা সজীব এখন নিজেও পরিবারে আর্থিকভাবে অবদান রাখেন। ৫ মৌসুম ধরে ঢাকা প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগ খেলছেন গাজী টায়ার্স ক্রিকেট একাডেমির হয়ে। সর্বশেষ মৌসুমের পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন সিসিডিএম বেস্ট অলরাউন্ডার অ্যাওয়ার্ড (দ্বিতীয় বিভাগ)।

এক দশকের বেশি সময় ক্রিকেটেই মগ্ন থাকা সজীব বলছেন, ‘এ ধরণের পুরষ্কার দেওয়াতে আমরা নিজেরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। খেলার প্রতি আরও আগ্রহ বাড়ছে। পরিশ্রম করার চেষ্টাটা আরও বাড়ছে। ভালো লাগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এসব উদ্যোগ দেখে, তরুণদের উৎসাহী করতে কিছু করতেছে। এতে আমাদেরও দায়িত্ব বেড়ে যায়, বাংলাদেশকে কিছু দেওয়ার তাড়না বেড়ে যায়। উৎসাহ পাচ্ছি, যারা পরবর্তীতে আসবে তারাও উৎসাহ পাবে। ‘

নিজের আদর্শের কথা জানাতে গিয়ে যোগ করেন, ‘অনুসরণের কথা বললে ভিরাট কোহলি, উনাকে অনুসরণ করি। তার মানসিকতা, খেলার ধরণ বেশ ভালো লাগে। আর দেশে সাকিব ভাই। আমি নিজেও অলরাউন্ডার বলে উনাকে আলাদা করে অনুসরণ করি।’

যুব বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তবে পুরোনো সতীর্থ আকবর আলি, শরিফুল ইসলাম, মাহমদুল হাসান জয়, শামীম পাটোয়ারিদের সাথে এখনো যোগাযোগ আছে সজীবের। ব্যস্ততার কারণে জমিয়ে আড্ডা হয়তো দেওয়া হয় না। কিন্তু বন্ধুদের কেউ কেউ জাতীয় দলে খেলছেন এখনই ভাবতে ভালো লাগে এই অলরাউন্ডারের। এমনকি তার ঘুরে দাঁড়ানোর নৈপথ্যেও আছে তাদের ইতিবাচক বার্তা।

সজীব মিয়া জানান, ‘হ্যাঁ সবার সাথে তো মোটামুটি যোগাযোগ হয়। ওরাও ব্যস্ত থাকে সেভাবে তো আর সম্ভব না। দেখে ভালো লাগে তাদের কেউ কেউ জাতীয় দলে খেলছে। জয়,শরিফুল, শামীম জাতীয় দলে খেলেছে। দেখে ভালো লাগে এক সময় আমার সতীর্থ ছিল এখন জাতীয় দলে খেলে।’

‘ওদের দেখে অনুপ্রাণিত হই। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ার ওরাও বলছিল বন্ধু একটা সময় খারাপ যাবেই। তুই চেষ্টা কর ভালো কিছু হবে। তার প্রমাণ আসলে আজকের এই পুরষ্কার।’

নাজমুল হাসান তারেক

Read Previous

হেডিংলিতে জয়ের পথে ইংল্যান্ড

Read Next

রেকর্ড গড়েও উদযাপনের সুযোগ পাচ্ছেন না খালেদ

Total
0
Share