

সাবেক জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটার তাতেন্দা তাইবুর জীবন যেন কোনো সিনেমার গল্প। বেশ সম্ভাবনা নিয়ে জিম্বাবুয়ে দলে ডাক পাওয়া, যতদিন খেলেছেন রেখেছেন সেটির ছাপ। সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে দলকে দিয়েছেন নেতৃত্ব, দেশের ক্রিকেট বিরোধে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়ায়। ফিরে এসে জিম্বাবুয়ে জার্সি গায়ে জড়ালেও ২০১২ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে স্থায়ীভাবে বিদায় বলেন। লম্বা সময় ধর্মের পেছনে ব্যয় করেন, চার্চে সঁপে দেন নিজেকে।
পরে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের লিভারপুলে, একটি ক্লাবে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এবার তাইবু এসেছেন বাংলাদেশে। কাজ করছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) কোচ হিসেবে। সম্প্রতি ‘ক্রিকেট৯৭’ কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাইবু কথা বলেছেন আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালী অতীত, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হলো-
ক্রিকেট৯৭: বাংলাদেশে কাজ করাটা কতটা উপভোগ করছেন?
তাতেন্দা তাইবু: বাংলাদেশে কাজ করাটা আমি খুবই উপভোগ করছি। গত দুইমাসে এখানকার যতগুলো ছেলের সাথে আমি কাজ করেছি তারা মনেপ্রাণে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চায়। আমি অনেক দেশের ছেলেদের মাঝেই এমন কিছু দেখেছি কিন্তু এদের লক্ষ্যটা দৃঢ়, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে মুখিয়ে আছে। কোচ হিসেবে এমন কিছু আমাকে সাহায্য করে কারণ আমি কিছুটা বাড়তি ধাক্কা দিতে পারি তাদের। আর এসব কারণেই সত্যি বলতে এখানে কাজ করাটা আমি উপভোগ করছি।
ক্রিকেট৯৭: আপনিতো জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ইংল্যান্ডেই বসবাস করছিলেন। ওখানে কোচিং নিয়েও কাজ করছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাব পেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল?
তাতেন্দা তাইবু: সিদ্ধান্ত নিতে আমি কোনো সময় নিইনি। বাংলাদেশ সবসময় আমার হৃদয়ের কাছেই অবস্থান করে। আমি মাত্র দুই মাস এখানে কাজ করছি, তবে ছেলে-মেয়েদের সাথে আমার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা অসাধারণ।
ক্রিকেট৯৭: একদিন পরই শুরু হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন দেখেন?
তাতেন্দা তাইবু: আমি মনে করি বাংলাদেশ খুবই ভারসাম্যপূর্ণ একটা দল। আমার বিশ্বাস তারা ভালো ক্রিকেট খেলবে। গত ২০ বছরে তারা দল হিসেবে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করেছে। বেশি দূরে নয়, গত ৩ মাসের দিকে তাকালেও বলতে হয় তারা সেরা সময়ে আছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মত দলকে সহজেই হারিয়েছে, ভালো ক্রিকেট খেলেছে। যে কারণে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাদের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
ক্রিকেট৯৭: দল হিসেবে বিশ্বকাপে কাদের সমর্থন দিচ্ছেন?
তাতেন্দা তাইবু: বাংলাদেশে আমি কোচিং পেশায় এসেছি। বাংলাদেশে এসে এখনো পর্যন্ত যা দেখছি তাই উপভোগ করছি। সে ক্ষেত্রে একটা পক্ষপাতিত্বের দিক তো থেকেই যায়। আমি বাংলাদেশকেই সমর্থন দিচ্ছি।
ক্রিকেট৯৭: এবারের বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে অংশ নিতে পারছেনা। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এমন পরিস্থিকে কীভাবে দেখছেন?
তাতেন্দা তাইবু: জিম্বাবুয়ের হয়ে আমি খেলেছি। আমি জীবনে যা কিছু অর্জন করেছি এখনো পর্যন্ত তার সবটুকুই দেশটির হয়ে খেলার কারণেই। জিম্বাবুয়ে নিয়ে যখনই কথা বলবো আমি আবেগপ্রবণ হব। তারা এবারের বিশ্বকাপে খেলতে পারছেনা, এটা আমাকে বেশ পোড়ায়। এর বেশি কিছু হয়তো বলতে পারবোনা…।
ক্রিকেট৯৭: যে জিম্বাবুয়েকে আপনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন সে জিম্বাবুয়ে কোথায় হারালো? ভবিষ্যতে সে সোনালী সময় ফিরে আসবে বলে মনে করেন?
তাতেন্দা তাইবু: আমার মনে হয় এটা আলৌকিক ঘটনা হবে যদি আমি যে জিম্বাবুয়েকে প্রতিনিধিত্ব করেছি সে জিম্বাবুয়ে আবার ফিরে আসে। আমি যখন শুরু করেছি তার আগেই জিম্বাবুয়েতে বেশ বড় বড় তারকারা খেলেছে। একে একে যদি নাম ধরে বলি সেখানে থাকবে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, অ্যালিস্টায়ার ক্যাম্পবেল, হিথ স্ট্রিক, স্ট্রুয়ার্ট কারলাইল, গাই হোয়াইটটাল…। আমরা যে সময় পার করেছি সেটা অদূর ভবিষ্যতে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখিনা। এরপর যারাই খেলেছে, কোনোভাবে তুলনাও করা সম্ভব না। যেটা বললাম তেমন কিছু হলে আলৌকিকই বলতে হবে।
ক্রিকেট৯৭: বাংলাদেশে আপনার প্রিয় ক্রিকেটার কে?
তাতেন্দা তাইবু: আপনি বেশ কঠিন এক প্রশ্ন করে বসলেন। আমি সম্ভবত এটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারবোনা। কারণ এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। বর্তমান জাতীয় দলেও খেলছে এমন বন্ধু আছে। ফলে একজনের নাম নিলে সেটা ভালো দেখাবেনা (হাসি)। সুতরাং এ প্রশ্নের সোজা কোনো জবাব না দেওয়াই সম্ভবত ভালো পন্থা।
ক্রিকেট৯৭: বিকেএসপির ক্রিকেটারদের মাঝে কেমন সম্ভাবনা দেখছেন?
তাতেন্দা তাইবু: আমি এখানে প্রচুর সম্ভাবনাময় ছেলে-মেয়েকে দেখছি। তাদের ইচ্ছেশক্তি আমাকে মুগ্ধ করে। আমি বলতে পারি এদের সবারই ভালো সম্ভাবনা আছে একদিন জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করার। আমি তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। কিছু কিছু খুবই প্রতিভাবান ক্রিকেটার চোখে পড়েছে। এখানকার সুযোগ সুবিধা ও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা হয়তো তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
আকাশের সীমা আছে, স্বপ্নের কোনো সীমা নেই। বিকেএসপি যে ধরণের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে তা নিশ্চিতভাবেই একজন ক্রিকেটারকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সহায়ক। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ জাতীয় দলের জন্য বিকেএসপি ভবিষ্যতে আরও বেশি ক্রিকেটার তৈরি করতে পারবে।
ক্রিকেট৯৭: জিম্বাবুয়ে থেকে একটা সময় ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন। সেখানে ক্রিকেট খেলেছেন, কোচিং করিয়েছেন। ইংল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো কোনো জায়গায়?
তাতেন্দা তাইবু: পার্থক্যগুলো আমার কাছে খুবই স্পষ্ট। বিকেএসপির সুযোগ সুবিধা পর্যবেক্ষণ করে আমি বলতে পারি অন্যতম সেরা। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই ইংল্যান্ডে আরও কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু এখানেও অনেকটা কাছাকাছি মানের। এখানে একটা অন্যরকম পরিবেশ আছে, ক্রিকেটারদের আগ্রহের ব্যাপার আছে। এখানকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যে ক্ষুধা আমি দেখি তা ইংল্যান্ডে আপনি পাবেন না।
এরপরেও কেন ইংল্যান্ড বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করে? এর উত্তরে বলতে হবে বেশ গুছানো ভবিষ্যত পরিকল্পনা। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে আবেগ দিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেটা ইংল্যান্ডে চোখে পড়বেনা। আগামী মাসেই হয়তো ইংল্যান্ডের ক্লাব ক্রিকেটের সূচি প্রকাশ হবে। জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া দেশটির বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সূচি ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়ে গেছে। দুই-আড়াই মাস প্রস্তুতির জন্যই সময় পাবে তারা।
এমনকি আগামী বছরের মাঝামাঝি কিংবা শেষে কোন কোন খেলা আছে সেসবও নির্ধারিত হয়ে আছে, ক্রিকেটাররাও জানে। এটা হচ্ছে গুছানো পরিকল্পনা। কখন, কাদের বিপক্ষে কয়টা ম্যাচ এসব জানা থাকলে ট্রেনিং সেশনগুলোও সেভাবে সাজানো যায় সহজে। এখানে যেটা হয় ট্রেনিংয়ের পর ট্রেনিং চলে উদ্দেশ্যহীনভাবে, কিছু ওয়ার্ম আপ ম্যাচ থাকে, এরপর একদম কোনো টুর্নামেন্ট। ইংল্যান্ডে ছেলেরা ট্রেনিংয়ের চেয়েও ম্যাচ খেলার সুযোগ বেশি পায়। এই জায়গাটা বড় পার্থক্য বলা যায়।
গুছানো পরিকল্পনা করা থাকলে সেটা খেলোয়াড়দের সাহায্য করবে। কারণ গেম সেন্সটা এখানকার খেলোয়াড়দের কম থাকে ম্যাচ কম খেলায়, তাদের প্রতিভা, সামর্থ্য দারুণ। ফিটনেস হয়তো আলাদা কাজ করে উন্নতি করা যায়। কিন্তু টেকটিক্যাল দিক ও মানসিকতা ম্যাচ খেলতে খেলতেই বাড়ে। ম্যাচ পরিস্থিতি আপনাকে অনেক নতুন নতুন জিনিস শেখাবে। এসব হল ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের পার্থক্য।
ক্রিকেট৯৭: গত মাসে বাংলাদেশ নারী দল যখন বিকেএসপিতে ক্যাম্প করেছে তাদের সাথে আপনিও কাজ করেছেন। কেমন দেখলেন?
তাতেন্দা তাইবু: ওহ, বাংলাদেশ নারী দলের ক্রিকেটারদের সাথে কাজ করাটা দারুণ ব্যাপার ছিল। তারাও বেশ প্রতিভাবান একটা গ্রুপ ছিল। মেয়েরা ভালোই পরিশ্রম করে, কোচরাও চেষ্টার কমতি রাখছেনা। তাদের সাথে কিছু সময় কাজ করে আমিও উপভোগ করেছি। তবে মেয়েদের ক্রিকেট সংস্কৃতিতেও খানিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করি। তাতে তারা আরও ভালো ফল বয়ে আনবে বাংলাদেশের জন্য।
আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছি সেটা হলো মেয়েদের আন্তঃযোগাযোগ, মানসিকতা উন্মুক্ত করার সুযোগ বাড়ানো। এমন কিছুতে তারা ম্যাচে নিজেদের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্পর্কে নিজেই অবগত থাকবে। এর বাইরে সবকিছু আমার কাছে ঠকঠাক লেগেছে, কাজ করে উপভোগ করেছি।
ক্রিকেট৯৭: যতটুকু জানি বাংলাদেশে আপনার প্রচুর বন্ধু আছে। এবার বাংলাদেশে আসলেন বেশ ভালো সময়ের জন্যই। তাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে?
তাতেন্দা তাইবু: হ্যাঁ, এখানে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। আমি এসেই ইতোমধ্যে তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করেছি। কোভিডের কারণে সবার সাথে এখনো দেখা করার সুযোগ হয়নি। আর আমি থাকছিও শহর থেকে একটু দূরে। তবে সবার সাথে নিয়মিত কথাবার্তা হচ্ছে। পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক হলেই হয়তো আমরা দেখা করবো, কিছু সময় আড্ডা দিয়ে কাটাবো।