
গতকাল (১৫ মার্চ) ঢাকা ক্লাবের স্যামসন সেন্টারে করা হয় সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেমের লেখা ‘ঐতিহ্য প্রকাশনীর’ ‘ক্রিকেট রিভিজিটেড’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। ১৯৬৭ সালে স্কুলে পড়াকালীন সময়েই ঢাকা লিগে অভিষেক হয় শাকিল কাসেমের। আজাদ বয়েজ ক্লাব, ইসলামিয়া স্পোর্টিং (বি দল), সূর্যতরুণ, ওয়ারির মত ক্লাবে খেলেছেন লম্বা সময় ধরে। ১৯৭৭ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কোন বিদেশি (এমসিসি) দলের বিপক্ষে খেলা স্কোয়াডেও ছিলেন শাকিল কাসেম।
‘ক্রিকেট রিভিজিটেড’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ঢাকা ক্লাবে তখনকার তার সতীর্থদের নিয়ে এক মিলনমেলা বসে। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা ছাড়াও ৯০ এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ঢাকা লিগে যাদের সতীর্থ ও বিপক্ষ দল হয়ে খেলেছেন। বিকেল ৪ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত চলা অনুষ্ঠানে নানাভাবে স্মৃতিচারণ হয়েছে সত্তর ও আশির দশকের বাংলাদেশ ক্রিকেটের।
মোড়ক উন্মোচনের সময় তার দুই পাশে ছিলেন দেশের ক্রিকেট উত্থানের দিনগুলোতে অন্যতম দুই সেরা তারকা। একজন তখনকার তুখোড় ব্যাটসম্যান ও মিডিয়াম পেসার ইউসুফ বাবু আরেকজন সৈয়দ আশরাফুল হক। যিনি ১৯৭৭ সালে এমসিসিকে বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে খেলোয়াড় হয়েও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তার দারুণ বোলিং পারফরম্যান্সেই ১৯৭৯ সালে ফিজির বিপক্ষে আইসিসি ট্রফিতে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হলেও এদিন উপস্থিত ছিলেন সেসময়কার সংগঠক, ক্রীড়া সাংবাদিক, কোচ, ধারাভাষ্যকার। যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিছুই না থাকার দিনগুলোতে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার ছলে সবাই ফিরে গেছেন নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলোতে। যখন কোন কিছু পাওয়া নয় স্রেফ ক্রিকেটকে ভালোবেসে মাঠে পড়ে ছিলেন শাকিল কাসেম, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, ইউসুফ বাবু, সৈয়দ আশরাফুল হক, তরিকুজ্জামান মুনীর, মোহাম্মদ সেলিমরা।
আজাদ বয়েজ ক্লাবে একসাথে খেলার সময়টায় সারাদিন পর সন্ধ্যার আড্ডা, সৈয়দ আশরাফুল হকের ইস্কাটনের বাসায় একবারের জন্য হলেও শাকিল কাসেমের ঢুঁ মেরে আসা সবই উঠে আসে। ঢাকার ক্রিকেটে খেলার সময় স্লিপে দাঁড়িয়ে শাকিল কাসেম গুনগুন করে ইংরেজি গান গাইতেন। অধিনায়ক আশরাফুল হক একদিন জিজ্ঞেস করেই বসলেন তুই গুনগুন করিস ভালো কথা তবে ইংরেজিতে কেন? শাকিল কাসেমের সহজ স্বীকারোক্তি ক্রিকেট নাকি ইংলিশদের খেলা তাই ইংরেজিকেই মাঠে ধারণ করছি।
এমন সব মজার স্মৃতির ফাঁকে সৈয়দ আশরাফুল হক বেদনার স্মৃতিও সামনে আনলেন। শাকিল কাসেমের সাথে নিজের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে গিয়ে তুলে ধরলেন তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর লেখা ৪ পৃষ্ঠার কলামের বিষয়টিও। তবে অশ্রুসিক্ত নয়নে ঐ টুকুনই মন খারাপ করানো স্মৃতি। ক্রিকেটার, কোচ, সাংবাদিক, সংগঠক ও ক্রিকেট বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরী তার ক্যারিয়ারের প্রথম ছক্কায় অবদান রাখায় ধন্যবাদ দিলেন শাকিল কাসেমকে।
তিনি বলেন, ‘এমনিতে আমার ক্যারিয়ারে ছক্কার সংখ্যা নেই বললেই চলে। যে কয়েকটা মেরেছি তার প্রথমটায় আবার অবদান আছে শাকিলের। আমি তখন ধানমন্ডির হয়ে খেলি, শাকিল ওয়ারিতে। আউটার স্টেডিমামের তিন নম্বর মাঠে খেলা। আমি ভুল করে না থাকলে লং অন দিয়ে উড়িয়ে মেরেছি। বল শাকিলের হাতে ধরা পড়ে, আম্পায়ার আউট দিয়ে দিয়েছে।’
‘কিন্তু শাকিল জানালো সে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে থেকে ধরেছে ফলে আউট না হয়ে উলটো ছক্কা লেখা হল আমার নামের পাশে। আসলে তখন কিন্তু এসব ম্যাচেও প্রচুর দর্শক থাকতো, আর বাউন্ডারিতে দড়ির তেমন ঠিক ঠিকানা থাকতোনা। শাকিল স্বীকার না করলে আমি কিন্তু আউটই। তাই আজ এতদিন পর এসে শাকিলকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়।’
এদিকে অনুষ্ঠানের একদম শেষভাগে সাবেক ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, কলাম লেখক বিসিবির বোর্ড পরিচালক, জাতীয় ক্রিকেট একাডেমির চেয়ারম্যান শাকিল কাসেম স্মৃতিচারণ করলেন পুরোনো সব দিন। টিভি কাভারেজ, লোভনীয় আর্থিক নিশ্চয়তা, তারকাখ্যাতি পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকা সত্বেও কেন ক্রিকেট খেলেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্ম লগ্নে।
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা যারা ক্রিকেট খেলেছি তারা কিসের জন্য খেলেছি? তখন তো এখনকার মত টাকা পয়সা নাই, টিভি কাভারেজ ছিলনা, স্পন্সর ছিলনা। আমরা কিসের জন্য খেলতাম? আমরা অন্য কিছুর জন্য খেলতাম না। আমরা লেখা পড়া ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম।’
‘আমি কলেজ ফাঁকি দিয়ে খেলতাম, স্কোরারকে বলে দিতাম নাম পত্রিকায় পাঠিওনা। কারণ বাবা দেখলেই জিজ্ঞেস করবে তুমি খেললা কীভাবে? তোমার তো কলেজে থাকার কথা। এসব মূলত আমাদের খেলাটার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল।’
‘এমসিসির সাথে প্রথম বাংলাদেশ দল যখন খেললাম আমাদের থাই প্যাড ছিলনা, এটা ছিল না, ওটা ছিলনা। হেলমেট তো নাই তখন। ২৫ টাকা দৈনিক ভাতার উপরে আমরা খেলেছি। কিন্তু আমরা বাংলাদেশকে ঐ ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করেছি। ওখান থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট মানচিত্রে যোগ হয়েছে। এরপর ক্রিকেট আস্তে আস্তে এগিয়েছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে।’