

আগুনে পুড়ে পুড়ে সোনা নাকি খাঁটি হয়! দিন দুয়েক আগে নিজের ফেসবুক পেইজে পেসার তাসকিন আহমেদ এক ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তাকে দেখা যায় জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে কোন সমস্যা ছাড়াই হেঁটে যাচ্ছেন। না, কোন জাদু মন্ত্র নয় স্রেফ মনের জোরেই এমন কঠিন এক কাজ করে বসলেন টাইগার পেসার।
বলা হয়ে থাকে মনের জোরে অসাধ্য সাধনও সম্ভব। কিন্তু এই মনকেই অগ্রাহ্য করা হয় সবচেয়ে বেশি। উন্নত দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যতটা খোলামেলা কথা বলা যায় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়না আমাদের সংস্কৃতিতে। বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটির বেশি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছে।
২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭% (২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ) নানা ধরণের মানসিক রোগে আক্রান্ত। যাদের ৯২ শতাংশই আবার চিকিৎসার আওতায় নেই। মূলত মানসিক স্বাস্থ্য মানেই এখানে ধরা হয়ে থাকে ‘পাগলামি’।
যে কারণে চিকিৎসকের কাছে যেতেও সংকোচ বোধ করে বেশিরভাগ রোগী। প্রতিবছরই বিশ্বে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আ*ত্মহ*ত্যার পথ বেছে নেয় শুধু মানসিকভাবে বিষণ্ণ হয়ে।
স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলে আসছে, ‘কেবল নিরোগ থাকাটাই স্বাস্থ্য নয়; বরং শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য।’ অথচ স্বাস্থ্য বলতেই কেবল শারীরিক দিকটাই বিবেচনায় নেওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মত দেশের ক্রিকেটাররা হরহামেশাই মানসিক স্বাস্থ্য অবনতি হওয়াকে কারণ দেখিয়ে ছুটি নেয়। যা থেকে স্পষ্ট মানসিক দিকটাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় সেসব দেশে। গত বছর বাংলাদেশ দলের কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোও জানিয়েছেন এমন সংস্কৃতি গড়তে চান তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের নিয়েও।
বাংলাদেশ দলের অন্যতম সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা একবার আক্ষেপ করে জানিয়েছিলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ আমাদের এখানে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়না। আমাদের সামাজিক বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা এখানে মার্কাস ট্রেসকোথিক বা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মত মানসিক অবসাদ নিয়ে কথা বলতে পারিনা।’
‘যদি কেউ বলে সে ভালো বোধ করছেনা তবে ধারণা করা হয় সে ভয় পাচ্ছে কিংবা অজুহাত তৈরি করছে। এমনকি অনেকে এভাবে ভাবেও না। যারা অনুভব করে, তারাও প্রকাশ করেনা।’
তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে পেছনে ফেলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা শুরু করেন পেসার তাসকিন আহমেদ। শরীরের সাথে মনের যে দারুণ সমন্বয় প্রয়োজন ভালো পারফরম্যান্সের জন্য তা অনুধাবন করে একজন মাইন্ড ট্রেনারের সাথে নিয়মিত কাজ করছেন ২০১৮ সাল থেকে।
মাইন্ড সেশনে এতটাই মানসিকভাবে শক্ত হয়েছেন যে জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়েও হেঁটেছেন অনায়েসেই। তবে কাজটা কোনভাবেই সহজ ছিলনা, ভাবনার জায়গাটাও বদলে দিয়েছেন সাবিত রায়হান নামের জনপ্রিয় একজন মাইন্ড ট্রেনার। তাসকিন ছাড়াও সৌম্য সরকার, এনামুল হক বিজয়, ইমরুল কায়েস ও মেহেদী হাসান মিরাজের মত জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাও কাজ করছেন তার সাথে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় মাইন্ড ট্রেনিংয়ের মত একটা কঠিন বিষয় নিয়ে কাজ করছে তার প্রতিষ্ঠান সাবিত ইন্টারন্যাশনাল। দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন পেশার লোকেরা নিয়মিত তার মাইন্ড সেশনের তালিম নিচ্ছেন। ‘ক্রিকেট৯৭’ এর সাথে আলাপে সাবিত রায়হান জানান কীভাবে তাসকিনদের সাথে কাজ শুরু, বাংলাদেশে এমন কিছু শুরুর ভাবনাটা কীভাবে এলো এবং নিজের হতাশাময় সময় পার করে আসার গল্প।
সাবিত রায়হান বলেন, ‘আমার আন্তর্জাতিক কিছু মাইন্ড ট্রেনিং নিজের করা আছে। পরিবার ও কাছের কিছু মানুষের কিছু কাজ আমি শুরুতে এমনিতেই করতাম এবং দেখলাম ফলাফল ভালো হচ্ছে। আসলে গবেষণায় দেখা যায় পৃথিবীর ৭০০ কোটির বেশি মানুষের মধ্যে ২০০ কোটির বেশি মানুষ হতাশায় ভুগছে। মনে হল যে মানুষকে সাহায্য করা উচিত, এভাবেই শুরু করা। প্যাশন থেকে শুরু এখনো প্যাশনের জায়গা থেকেই কাজ করি।’
‘আমাদের মূল নজর হল যে জায়গাগুলোতে মানুষ সমস্যায় ভুগছে সেসব জায়গা থেকে বের করে আনা, সাহায্য করা। শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। একজন একজন করে করানো। এখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে, বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ আসে। কাজটা আমি ভালোবেসে করি। একটা সময় আমি নিজে হীনমন্যতায় ভুগতাম। সেখান থেকে আমি নিজে বের হয়ে আসতে পারাটা, মানুষকে সাহায্য করতে পারাটা অনেক কিছু। আমি সত্যি অনেক ভালোবাসি এই কাজটা।’
ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সে শারীরিক ফিটনেসের সাথে মানসিক ফিটনেসের সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে তাসকিন, সৌম্যদের সাথে কাজ করার প্রক্রিয়া তুলে ধরেন, ‘পারফরম্যান্সের জন্য ফিজিক্যাল ফিটনেস যতটা প্রয়োজন আমার জায়গা থেকে আমি বলবো মেন্টাল ফিটনেস তার চাইতেও বেশি প্রয়োজন। শরীরের নিয়ন্ত্রণ তো আসলে মন থেকে হয়।আমার কাজ হল মানসিকতায় দীর্ঘ মেয়াদী একটা পরিবর্তন এনে দেওয়া।’
‘মোটিভেশনাল পরিবর্তন আমরা করিনা, কিন্তু নিজস্বতা তৈরি করা, নিজের ভেতরের নির্ভরতা যেন শক্তিশালি হয় এসব নিয়েই কাজ করা হয়। রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড কাজ করা হয়, আমরা জিজ্ঞেস করি যে আপনি কি চান? উদাহরণস্বরুপ সৌম্যকে গত টুর্নামেন্টে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে সে কি চায়? তার লক্ষ্য ছিল দুইটা ফিফটি হাঁকানো যেটা সে করেছে। এখন পরবর্তী ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ সামনে রেখে আবারও আমাদের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।’
‘এটার ভিত্তিতে মাইন্ডে যে ইনপুটগুলো দেওয়া দরকার সেটা আমরা করবো। শরীরটাতো আমরা মাইন্ডের সাহায্য নিয়েই নাড়াচাড়া করি।একজন বোলার যখন দুইটা বল খারাপ করার পর মানসিকভাবে ডাউন হয়ে যায়, সাথে সাথে কামব্যাক করতে না পারলে পুরো ওভারটাই খারাপ যাবে, ম্যাচটাই খারাপ হবে। ঐ জায়গাটাতেই আসলে আমার কাজ, সে যেন মুহূর্তের মধ্যেই কামব্যাক করতে পারে।’
যেসব ক্রিকেটারের সাথে কাজ করছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন তাসকিন আহমেদের। ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে নানাভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া এই পেসার নিজেকে নতুন উদ্যমে খুঁজে পান সাবিত রায়হানের সংস্পর্শে।
View this post on Instagram
তাসকিনের সাথে কাজ করা ও তার অনুধাবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সাবিত রায়হান বলেন, ‘তাসকিন এ বিষয়ে অনেক সিরিয়াস। সে ২০১৮ সালে শুরু করে। তার নিজস্ব চিন্তাটা হল এমন যে নিয়মিত যেমন ফিটনেস ট্রেনিং করে তেমন মেন্টাল ট্রেনিংটাও যেন নিয়মিত করতে পারে ভালো পারফরম্যান্সের জন্য। ওর সাথে কাজ চলছে দুই বছর হল, ২০১৮ বিপিএলের আগে থেকে।’
অন্যদের উপর প্রয়োগের আগে সাবিত রায়হান নিজে করেছেন বেশকিছু আন্তর্জাতিক মাইন্ড সেশন। তিনি বলেন, ‘আমি বেশকিছু আন্তর্জাতিক মাইন্ড সেশনের কোর্স করেছি। সবগুলো ভারতে গিয়ে করা। বাইরের বেশ কিছু ট্রেনারকে পেয়েছি যেমন শ্রীলঙ্কান রঞ্জন ডি সিলভা, ইংল্যান্ডের ড. ডেভিড জন লিংকন স্যার, আমার ট্রেনারদের মধ্যে আছেন রাম বার্মা স্যার। ফায়ার ওয়াকিংয়ের উপর সার্টিফিকেট আছে। যখন আমি জানি আমার কাজ শেখা কিন্তু সার্টিফিকেট দরকার তখন আমি আন্তর্জাতিক এসব ট্রেনিং করেছি।’
করোনাকালে একটি লাইভ অনুষ্ঠানে এসে তাসকিনও জানিয়েছেন তার বদলে যাওয়া মানসিকতার জন্য মাইন্ড সেশন কতটা কাজে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘মাঝখানে আমি অনেক হতাশ ছিলাম, যেমন শরীরের ওজন অনেক বেড়ে গেছে। আমি অনেক ক্যাজুয়াল হয়ে গিয়েছিলাম, আমার ফিটনেস লেভেল, ফিল্ডিং সবকিছু মিলিয়ে। বলে পেস কমে গিয়েছিল, আমি মোরালি অনেক ডাউন ছিলাম। এ জিনিসগুলো আমাকে আসলে মানসিকভাবে হতাশ করছিল।’
‘সত্যি বলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আশেপাশের পরিবেশ একটা পর্যায়ে মনে করাচ্ছিল আমাকে দিয়ে আর হবেইনা। আমি মেন্টালি ইম্প্রুভমেন্টের জন্য সাবিত রায়হান নামের একজন বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলি। উনি একজন মাইন্ড ট্রেনার।’
‘তার সাথে আমি কথা বলি যে ভাই আমি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। বিশ্বমানের অ্যাথলেট হতে যেরকম মাইন্ড সেটাপ করার দরকার সেরকম করতে চাই। একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে আমার স্বপ্ন, ইচ্ছে আমি যেন একজন বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার হতে পারি, অ্যাগ্রেসিভ ও অনেক জোরে যেন বল করতে পারি।’