

বেক্সিমকো ঢাকার পেসার শফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে আলো ছড়িয়েছেন। এই টুর্নামেন্ট দিয়ে স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় তরুণ এই পেসারের। পাদপ্রদীপের আলো কাড়ার মঞ্চ এর আগে ঠিকঠাক না পেলেও নির্বাচকদের নজরে পড়েছেন। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের পরিচিত মুখ নন, তবে ২০১৮ সালেই হয়েছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক।
দারুণ কিছুর ছায়া দেখতে পেয়ে বাংলাদেশ ‘এ’ দল, জাতীয় দলের কন্ডিশনিং ক্যাম্প হয়ে ঠাই হয়েছে এবারে হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ইউনিটের স্কিল ক্যাম্পেও। তবে সব ছাপিয়ে চলতি বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে বেক্সিমকো ঢাকার হয়ে রেখেছেন ভালো অবদান। ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট (৮ম সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক)। টুর্নামেন্টের মাঝপথে দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম শফিকুলকে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস হিসেবে উল্লেখ করেন।
দল প্লে-অফ (২য় কোয়ালিফায়ার হেরে) থেকে বিদায় নিলেও শফিকুল মুগ্ধ করেছেন বল হাতে। বয়সভিত্তিক দলে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকলেও ২০১৬ সালে পেসার হান্টে অংশ নিয়ে সেরা ২০ এ জায়গা করে নেন। তবে নজরে আসতে এতটুকুই যথেষ্ট ছিলনা, এরপরের গল্পে জড়িয়ে আছে ফরহাদ রেজা ও মুশফিকুর রহিমের নাম।
ক্রিকেট৯৭ এর সাথে একান্ত আলাপে বগুড়ার শফিকুল জানিয়েছেন তার এই পর্যায়ে আসার পেছনের গল্প, নিজের শক্তির জায়গা, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয়। নিচে পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল-

ক্রিকেট৯৭: বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ দিয়ে স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হল। দলের জয়ে অবদান রেখেছেন, সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় সেরা দশে আছে। টুর্নামেন্ট শেষে অনুভূতি?
শফিকুল ইসলাম: আসলে প্রথমবার তো, একটু নার্ভাসনেস ছিল। কিন্তু আমাদের দলে যারা খেলেছে, ভাইদের সাথে আগেও খেলা হয়েছে, চিনি সবাইকে, তাই নরমাল থাকার চেষ্টা করেছি। খুব একটা ভয় পেয়েছি এমন না। এ কারণে হয়তো মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়েছে। সতীর্থরা দারুণ সাহায্য করেছে।
ক্রিকেট৯৭: প্রথম শ্রেণির অভিষেক হয়েছে ২০১৮ সালে, একদিনের ম্যাচও খেলেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। কিন্তু স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে এবারই প্রথম। অন্য ফরম্যাটের সাথে টি-টোয়েন্টির পার্থক্যটা কেমন মনে হল?
শফিকুল ইসলাম: এর আগেতো টি-টোয়েন্টি এত বড় স্টেজে খেলিনি কখনো। এখানে আলাদা একটা চাপ থাকে। লংগার ভার্সন খেলেছি এরকম চপ থাকেনা। হঠাত করে যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে, ২০ ওভারের খেলাতো পুরো সময়টাই কঠিন। অন্য ফরম্যাটে একটু গা ছাড়া দেওয়া যায় কিন্তু এখানে এরকম কোন সুযোগ নেই।
ক্রিকেট৯৭: মুশফিকুর রহিমের সাথে একই দলে খেলা, ড্রেসিং রুম ভাগাভাগির অভিজ্ঞতা কেমন?
শফিকুল ইসলাম: এটা পুরোপুরি একটা ভাগ্যের বিষয় যে তার সাথে খেলতে পারা, ড্রেসিং রুম শেয়ার করা। অনেক কিছু বলেছে, মানে বেশ উজ্জীবিত করেছে। উনার সমর্থন না পেলে হয়তো এত ভালো খেলা হতনা। অনুশীলনে উনাকে বল করলে বলে দিত এরকম করতে হবে, ওরকম করতে হবে। এগুলো নিয়ে আমার সাথে আগে থেকেই কথা বলতো, কোথায় কি করলে ভালো হবে। উনি আমাকে বলেছে যে ফিটনেস নিয়ে একটু কাজ কর, দেখবি আল্লাহর রহমতে কোথাও আঁটকাতে হবে না। উনার এই সাপোর্টটা পাওয়াতে সবকিছু আমার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছে।

ক্রিকেট৯৭: মুশফিক আপনাকে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মত তারকার কাছ থেকে এমন প্রশংসা পাওয়াকে কীভাবে দেখছেন?
শফিকুল ইসলাম: আমি যখন এটা দেখেছি আমার অনেক ভালো লেগেছে। আসলে উনি যেরকম চেয়েছে আমি চেষ্টা করেছি সেরকম, হয়তো শতভাগ তার চাওয়া পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছি এ জন্যই হয়তো উনি খুশি হয়েছে। যা বলেছে তা না পারলেও করার চেষ্টা করেছি। এটাতেই উনি বেশি খুশি হয়েছে।
ক্রিকেট৯৭: বয়সভিত্তিক খেলার অভিজ্ঞতা নেই, অথচ ২০১৮ সালেই অভিষেক হয় প্রথম শ্রেণিতে। এরপর বিসিবির অধীনে ‘এ’ দল, অনূর্ধ্ব-২৩ দল, এইচপির মত বেশ কিছু জায়গায় সুযোগ হয়েছে। শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
শফিকুল ইসলাম: আল্লাহর অশেষ রহমতে (ব্রেক পাওয়া)। ২০১৬ সালে আমি পেসার হান্টে ছিলাম। অতটা ভালো করতে পারিনি, ২০ জনের মধ্যে ছিলাম। বগুড়া ফিরে গেছি। রাজশাহীর ফরহাদ রেজা ভাই বগুড়াতে আসেন ম্যাচ খেলতে। ওখানে বল করেছি, মোটামুটি ভালো বল হওয়াতে উনি পছন্দ করেছিল। এরপর উনিই আমাকে রাজশাহীর নেটে ডেকেছিল বোলিং করতে। ঐ বছর আমি আবার ঢাকায় প্রথম বিভাগ খেলছিলাম। তার মধ্যেই উনি আমাকে ফোন দেয়, জাতীয় লিগ চলছিল তখন।
উনি বলল তুই খেলবি আয়, এরপর খেলা শুরু হওয়ার আগে রাজশাহীতে আমরা এক সপ্তাহের মত পুরো দল অনুশীলন করি। এরপরই আমার প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক হয়। ঐ বছর দুইটা ম্যাচ খেললাম। তখন অনুশীলন থেকে শুরু করে সবকিছুই ভালো হচ্ছিল। বগুড়াতে মুশফিক ভাই আসছিল, উনি দুইদিন ব্যাটিং করেছিল। এরপর ঢাকায় গিয়ে জাতীয় দল বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে নেটে বল করেছিলাম। ওখান থেকেই মূলত মুশফিক ভাই বিসিবিতে বলে দিয়েছিল। বিসিবি থেকে আমাকে ডেকে নাম্বার নিয়েছে, পরে এইচপিতে অন্তর্ভূক্ত করে।
ক্রিকেট৯৭: এইচপির বর্তমান কোচ টবি রেডফোর্ডের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
শফিকুল ইসলাম: উনাকে আমার বেশ ভালো লাগে। কারণ, যাই করুক সবকিছুতে উনি ম্যাচের আবহ তৈরি করেন। এই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে উনার অনেক কিছুই কাজে দিয়েছে। লম্বা সময় খেলার মধ্যে ছিলাম না করোনার কারণে। কিন্তু এইচপির এক মাসের ক্যাম্পেই অল্প কিছু ম্যাচ ছিল, দুইদিনের ম্যাচ খেলেছি একটা, ওয়ানডে খেলেছি একটা, আর টি-টোয়েন্টি খেলেছি ২-৩ টা।
তবে আমাদের অনুশীলনেই উনি ম্যাচের পরিস্থিতি তৈরি করতেন। সেন্টার উইকেটে আলাদা ব্যাটিং, রান করানো এরকম করে ম্যাচের মত পরিবেশ তৈরি করতেন। বেশিরভাগ সময়ই অনুশীলন হত ম্যাচ পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে।
ক্রিকেট৯৭: জাতীয় দলের অভিজ্ঞ পেসার রুবেলের সাথে একই দলে খেললেন। তার কাছ থেকে কোন পরামর্শ পেয়েছেন?
শফিকুল ইসলাম: রুবেল ভাইয়ের কথা কি বলবো, উনি মানসিক যে সাপোর্ট টা দিয়েছে তা অনেক সাহায্য করেছে। মুশফিক ভাই সবসময় সমর্থন দিয়েছেন কিন্তু উনি ব্যাটসম্যান, উনি উনার জায়গা থেকে যা করার করেছেন। কিন্তু রুবেল ভাই বোলিংয়ের ব্যাপারে সাপোর্ট দিয়েছেন।
প্রথম দিন নেটে উনি আমার বোলিং দেখেছে, উনি আগে করেছে পরে আমি করেছি। উনি আমাকে বলল ভালো করতে পারবি তুই, চলিয়ে যা। তখন থেকেই আমার মনে হয়েছে আমি পারবো। প্রত্যেক ম্যাচে ড্রেসিং রুমে উনি বলতো আজকে ভালো করতে পারবি, ভালো হবে। মাঠে কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও উনারে বলতাম। অন্য যারা ছিল তাদেরও বলতাম, তারা সবাই সাহায্য করতো।

ক্রিকেট৯৭: আপনার বোলিংয়ের শক্তির জায়গাটা কি?
শফিকুল ইসলাম: পুরো টুর্নামেন্টে আমি লেংথ আর কাটারটা নিয়ে বেশি নজর দিয়েছি। কারণ ৮ মাসের মত ইনজুরিতে ছিলাম, গতবার এইচপির পরে ইনজুরিতে পড়ি। জাতীয় লিগের সময় ইনজুরিতে পড়লাম, ফ্র্যাকচার হয়। তারপর থেকে ৮ মাসের মত খেলাধুলার বাইরে ছিলাম। সময় পেয়েছি ২-৩ মাসের মত, বোলিং অনুশীলনের।
কিন্তু পেস, ইয়র্কার, বাউন্স এসব নিয়ে কাজ করা হয়নি। আগে থেকেই কাটারটা মারতাম, তো এটাতে কনফিডেন্স পেয়েছি দেখে এটাই চেষ্টা করেছি, অন্য কোন ভেরিয়েশনে যাইনি। সামনে চেষ্টা করবো ভেরিয়েশন নিয়ে কাজ করার ইন শা আল্লাহ। এখন নতুন বলে সুইং হয় আমার, পুরাতন বলে কাটার। এগুলো নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি অন্য কিছু নিয়েও সামনে কাজ করবো ইন শা আল্লাহ।
ক্রিকেট৯৭: দেশের অন্যতম সফল কোচ খালেদ মাহমুদের অধীনে খেলেছেন। তার সাথে কাজ করাটা কতটা উপভোগ করেছেন?
শফিকুল ইসলাম: আমার সৌভাগ্য হয়েছে উনার সাথে কাজ করতে পেরে, উনি আমাদের কোচ ছিলেন। উনি প্রথম দিনই বলে দিয়েছেন, জান খুলে বল করবি, কি হবে এটা ভাববি না। তুই যদি মনে করিস তোর বল ঠিক আছে, তাহলে ঠিক আছে। আর সবসময়ই অনুপ্রেরণা দিত, ভালো হচ্ছে আরও ভালো হবে।
এসব অনেক ভালো লেগেছে। আসলে কি করবো এরকম একটা ভয়, দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করতো এত বড় একজন কোচ। কিন্তু উনি এমনভাবে আমাদের সাথে মিশছেন মনে হয়েছে আমাদের টিমমেট, আমাদের সাথের বোলার। অনেক ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে উনার সাথে কাজ করে, বলে বুঝানোর মত না।
শফিকুলকে নিয়ে যা বলছেন তারাঃ
মুশফিকুর রহিম, বেক্সিমকো ঢাকা অধিনায়ক
‘আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস কি আমি তাহলে অবশ্যই বলব শফিকুল। যেভাবে সে বল করেছে বিশেষ শেষ তিন ম্যাচে সে অসাধারণ ছিল। তাকে দমিয়ে রাখা অতটা সহজ নয়। আমি মনে করি সে যেভাবে ক্রিজে এবং ক্রিজের বাইরে তার কাজটা করেছে এটা দুর্দান্ত। শুধু তাঁর বোলিংই নয় সে ফিল্ডিংয়েও ভালো করেছে। আমি মনে করি আমার দলের এই ধরণের ক্রিকেটাররা ভবিষ্যতে অনেকদূর এগিয়ে যাবে।’
রুবেল হোসেন, পেসার, বেক্সিমকো ঢাকা
‘ওর (শফিকুল ইসলাম) সাথে আমি যখন নেটে বোলিং করেছি তখনই দেখেছি মা শা আল্লাহ ভালো বোলিং করে। পেস আছে, ভেরিয়েশন আছে। তো ভালো ছেলে এবং ভালো বোলার। আমার কাছে মনে হয় ওর ফিউচার ভালো।’
নাসিরউদ্দিন ফারুক, সহকারী কোচ, বেক্সিমকো ঢাকা
‘ওর (শফিকুল ইসলাম) সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লেগেছে সেটা হল মানসিকতা। পেস বোলার সুলভ একটা আচরণ তার মধ্যে দেখা যায়। এখনই আমি বলছিনা সে খেলে ফেলবে জাতীয় দলে। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার মধ্যে থাকলে ভালো পর্যায়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। স্লোয়ারটা ও ভালো পারে। উইকেট যদি ওর ফেভারে থাকে বল ভেতরে ঢোকানোর দক্ষতা আছে।’