

মুশফিকুর রহিমের আন্তর্জাতিক অভিষেকটাই হয়েছে বড় এক উপলক্ষ্য দিয়ে। এমনিতে লর্ডসে খেলার সুযোগ কমই হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তার উপর অভিষেকতো সোনার হরিণ। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক তরুণ ক্রিকেটার যাকে দেখলে মনে হবে বয়স আরও কম, নেমে গেছেন স্টিভ হার্মিসন, ম্যাথু হোগার্ড, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফদের সামলাতে। দুই ইনিংস মিলে করতে পারেননি ২২ রানের বেশি। ১৫ বছর আগের আজকের দিনে (২৬ মে) টাইগারদের হয়ে অভিষেক হওয়া মুশফিক অবশ্য সময়ের সাথে সাথে পরিণত হয়েছেন খাঁটি সোনাতে।
নিজেই বলে থাকেন সাকিব, তামিমের মত প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা নন, লিটনের মত হাতে নেই নান্দনিক সব শট। তবে তার ছিল, আছে অদম্য ইচ্ছে শক্তি আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা। পরিশ্রম বিবেচনায় বাংলাদেশতো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটেই উদাহরণ হতে পারেন হাজার হাজার তরুণ ক্রিকেটারের। আর এই দুইয়ের মিশেলেই গড়পড়তা শুরু নিয়ে উইকেট রক্ষক এই ব্যাটসম্যান বনে গেছেন টাইগার শিবিরের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে।
ক্যারিয়ারের প্রথম ১০০ ওয়ানডেতে ২৬.২০ গড়ের মুশফিকের বর্তমান ওয়ানডে গড় ৩৬.৩২। প্রথম ২০ টেস্টেও গড় ৩০ ছুঁতে না পারা এই ব্যাটসম্যান ৭০ টেস্ট শেষে গড় নিয়ে গেছেন প্রায় ৩৭ এর কাছাকাছি। যা স্পষ্ট করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কতটা ধারাবাহিকভাবে রান করেছেন। বর্তমানে চার নম্বর পজিশনে খেলা বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন গায়ে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ তকমা লেগে যাওয়া এই ব্যাটসম্যান।
১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৩৭৪ ম্যাচে রান করেছেন প্রায় ১২ হাজার। ব্যাট হাতে বাংলাদেশের হয়ে আছে নানা কীর্তি, উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান বলে বিশ্ব রেকর্ডেও ভাগ বসিয়েছেন কয়েক জায়গায়, কোথাও কোথাও আবার ছাপিয়ে গেছেন অন্য সবাইকে।
অভিষেকের পর দলে জায়গা পাকা করা, দলের নেতৃত্ব ভার পাওয়া, নেতৃত্ব চলে যাওয়া কিংবা প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানো, উইকেট রক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরির মালিক হওয়া, ব্যাট হাতে অবদানে দলের নানা অর্জনের সাক্ষী হওয়া। চাইলেই ১৫ বছরের এই লম্বা যাত্রার সেরা ১৫ মুহূর্ত বের করা কঠিন। আর এই কঠিন কাজটাই কিনা করলেন মুশফিক নিজে।
আজ (২৬ মে) আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৫ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে কয়েকদিন আগে থেকেই বছর অনুসারে নিজের সেরা ১৫ মুহূর্তকে ধারাবাহিকভাবে ফেসবুক পেইজে প্রকাশ করতে থাকেন টাইগারদের অভিজ্ঞ এই সেনানী। নিচে পাঠকদের জন্য মুশফিকের চোখে নিজের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো তুলে ধরা হল-
১৫. ২০২০, ক্যারিয়ারের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি, বিপক্ষ জিম্বাবুয়ে
চলতি বছর বাংলাদেশ সবশেষ সিরিজ খেলেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরর মাঠে। একমাত্র টেস্টে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান মুশফিক। অপরাজিত ২০৩ রানের ইনিংস খেলেন মিস্টার ডিপেন্ডেবল, যেখানে অন্য কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের নেই দুইটি ডাবল সেঞ্চুরিও।
১৪. ২০১৯, টাইগারদের প্রথম বহুজাতিক সিরিজ জয়
এশিয়া কাপ ও বিভিন্ন ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল খেলা হলেও শিরোপা জয় যেন অধরাই থেকে যাচ্ছিল বাংলাদেশের। অবশেষে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত এলো গতবছর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে। ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় টাইগার শিবিরে। এমন প্রথমের অংশ হতে পারাটাও মুশফিক রেখেছেন নিজের সেরা ১৫ মুহূর্তে।
১৩. ২০১৮, এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৪৪ রানের ইনিংস
একদম শুরুতেই লিটন, সাকিবের বিদায়, ২ রান করা তামিমও হাতে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে। ঠিক ওখান থেকে মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে দুর্দান্ত জুটিতে বিপদ সামলে নেওয়া। মিঠুনের বিদায়ের পর আবারও ধস, তবে হাল ছাড়েননি মুশফিক। শেষ দিকে ভাঙা আঙ্গুল নিয়ে তামিম একহাতে ব্যাতিং করতে নেমে বাড়িয়েছেন মুশফিকের সাহস। দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে শেষদিকে তুলেছেন ঝড়। ১৫০ বলে ১৪৪ রানের ইনিংসটি অনেকের চোখেই তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস। ম্যাচের আগেরদিন ব্যথায় নেটে ব্যাট করতে না পারা মিস্টার ডিপেন্ডেবলের চোখেও ইনিংসটি অন্যতম সেরা মুহূর্ত।
১২. ২০১৭, আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল
নানা অনিশ্চয়তা আর কঠিন সমীকরণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সাকিব-মাহমুদউল্লাহর অসাধারণ এক জুটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয় পায় বাংলাদেশ। যে জয়ে নিশ্চিত হয় সেমিফাইনাল, ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিলেও মুশফিকের সেরা ১৫ মুহূর্তে জায়গা পেয়েছে সেটিও। ঐ বছরই সাকিবের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির পথে নিউইল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে ৩৫৯ রানের জুটি গড়েন মুশফিক। সাকিবের ২১৭ এর বিপরীতে মুশফিকের ১৫৯।
১১. ২০১৬, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট জয়
টেস্ট ক্রিকেটে এমনিতেই বাংলাদেশের অর্জনের খাতা খুব একটা ভারী নয়। তবে যে কটা সাফল্য চোখ বুঝে দেশের সকল ক্রিকেট ভক্তের চোখে অন্যতম প্রিয় তার একটি ইংল্যান্ডকে টেস্ট হারানো। ২০১৬ সালে মিরপুরে টাইগারদের স্পিন বিষে নীল হয়ে মাত্র এক সেশনেই অলআউট হয়ে হারতে হয় ইংলিশদের। নিজের সেরা ১৫ মুহূর্তে মুশফিকও জায়গা দিয়েছেন এই অর্জনকে।
১০. ২০১৫, একাধিক দলীয় সাফল্য
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ২০১৫ সাল লেখা থাকবে অন্যরকমভাবে। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করা, ঘরের মাটে পাকিস্তানকে ধবল ধোলাই, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয় সবই বড় সাফল্য। মুশফিক ঐ বছরের সব কীর্তিকে এক করে জায়গা দিয়েছেন সেরা ১৫ মুহূর্তে।
৯. ২০১৪, অনেক শিক্ষার বছর
পুরো বছরটিই দলীয় ব্যর্থতায় কেটেছে বাংলাদেশের। জয় যেন পরিণত হয় সোনার হরিণে। অধিনায়ক মুশফিককে হারাতে হয় সীমিত ওভারের নেতৃত্ব। নতুন কাপ্তান মাশরাফির নেতৃত্বে বছরে শেষ সিরিজে জিম্বাবুয়ে ধবল ধোলাই করে টাইগাররা। পরের বছর বিশ্বকাপের আগে যা আত্মবিশ্বাসে রসদ জোগায়। বছরটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুশফিক লিখেন, ‘A YEAR WE LEARNT A LOT’
৮. ২০১৩, প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ
২০১৩ সালে বাংলাদেশ দলে বেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো ক্রিকেট খেলে। গল টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেন মুশফিকুর রহিম। ঐ সিরিজেই শ্রীলঙ্কার মাটিতে প্রথম ওয়ানডে জয়ও আসে। একই বছর ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে দ্বিতীয়বারের মত ধবল ধোলাই। এসব অর্জনকে ২০১৩ সালের সেরা মুহূর্তে রেখেছেন মিস্টার ডিপেন্ডেবল।
৭. ২০১২, এশিয়া কাপ
২০১২ সালে প্রথমবার এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানের হারে স্বপ্নভঙ্গ, কোটি ভক্তের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ২০১২ সালে মুশফিকের স্মরণীয় মুহূর্ত।
৬. ২০১১, অধিনায়কত্ব, বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়
২০১১ সালে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার কারণে বিশ্বকাপ পরবর্তী এক সিরিজ পরই অধিনায়কত্ব হারান সাকিব আল হাসান। জাতীয় দলের নেতৃত্ব উঠে মুশফিকের কাঁধে। জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব অনেক বড় সম্মানের বলে মিস্টার ডিপেন্ডেবলের ২০১১ সালের প্রিয় মুহূর্তের তালিকায় উপরে দিকেই আছে সেটি। বছরে অন্য দুই স্মরণীয় মুহূর্ত বিশ্বকাপে রোমাঞ্চে মোড়ান ইংলিশ বধ ও ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি জয়।
৫. ২০১০, প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি
অভিষেকের ৫ বছরে মাথায় প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান মুশফিক। চতটগ্রামে ভারতের বিপক্ষে হাঁকানো সেঞ্চুরিটিই তার চোখে ঐ বছরে সেরা মুহূর্ত।
৪. ২০০৯, বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় টাইগাররা। দ্বিতীয় সারির ক্যারিবিয়ান দলের বিপক্ষে হলেও প্রথম যেকোন অর্জনেই আছে অন্যরকম অনুভূতি। ঐ বছরের মুশফিকের সেরা মুহূর্ত সেটিই।
৩. ২০০৮, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে জয়
বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার নিষিদ্ধ আইসিএল খেলতে চলে যাওয়ার পরও তরুণদের মিশেলে গড়া দল নিয়ে বাংলাদেশ পায় প্রথম কিউই বধের স্বাদ। ২০০৮ সালের স্মরণীয় মুহূর্তে মুশফিক জায়গা দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া প্রথম জয়টিকে।
২. ২০০৭, বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জয়
শিরোপার অন্যতম দাবিদার হয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ খেলতে যায় ভারতীয়রা। শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, বীরেন্দর শেবাগদের নিয়ে গড়া দলকেই কিনা গ্রুপ পর্বে হারিয়ে দেয় সাকিব, তামিম, মুশফিকের মত তরুণ ক্রিকেটাররা। ভারতকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেওয়া ম্যাচটিই ২০০৭ সালে মুশফিকের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। ম্যাচে তামিম, সাকিবের পাশপাশি মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে ফিফটি ও জয়সূচক রান।
১. ২০০৬, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫-০ তে সিরিজ জয়
নিজের অভিষেক সিরিজে হারে দল, অবশ্য দ্বিতীয় সিরিজেই ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়েকে ৫-০ ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। অভিষেকের পর প্রথম সিরিজ জয়কে ঐ বছরের সেরা মুহূর্তে রাখছেন মুশফিক।