‘সাকিবকে ভুল বোঝা খুব সহজ’

সাকিব আল হাসান রুদ্রদ্বীপ ব্যানার্জি

সাকিব আল হাসানের মধ্যে দু’টো সাকিব আল হাসান আছে। একটা আপনারা দেখতে পান। আর একটা পান না। আজ থেকে সাকিবকে চিনি না আমি। যখন ও মহাতারকা অলরাউন্ডার হয়ে ওঠেনি অখন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব, আমাদের পরিচয়। বারবার দেখতাম, বাইরের পৃথিবীতে কীভাবে মাঝে মধ্যেই খলনায়ক হয়ে যাচ্ছে সাকিব। ওর এক-একটা কথা নিয়ে বিতর্ক বেধে যাচ্ছে। চারদিক থেকে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, সাকিব আল হাসান উদ্ধত, বিতর্কিত এক ক্রিকেটারের নাম।

এসব দেখতাম আর কিছুতেই দ্বিতীয় সাকিব আল হাসানের সঙ্গে মেলাতে পারতাম না। যে সাকিবের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিকেট নিয়ে আড্ডা দিয়েছি, যে সাকিব আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সবচেয়ে বড় সাহায্য করেছিল।

আমাদের (ভারতের) মহেন্দ্র সিং ধোনি আর বাংলাদেশের সাকিবের মধ্যে আশ্চর্য একটা মিল আছে। দু’জনকেই মানুষ খুব দ্রুত ভুল বোঝে। দু’জনকে নিয়েই নিজস্ব একটা মতামত তৈরি করে ফেলে। মানুষটার সঙ্গে একটুও না মিশে, তাকে একটুও না জেনে।

সাকিবকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কটাই ধরা যাক জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন রাখায় আইসিসি দু’বছরের জন্য নির্বাসিত করেছে সাকিবকে। তারপর থেকে দেখছি লোকে বলে চলেছে সাকিব কত বড় অন্যায় করেছে। মিডিয়া লিখে যাচ্ছে। অনেক নামজাদা ক্রিকেটারকে দেখলাম বলছেন যে, সাকিবের নাকি আরো বেশি শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। আমাকে বলুন তো, সাকিব কি ম্যাচ গড়াপেটা করেছে? করেনি। সাকিব জুয়াড়ির প্রস্তাবকে পাত্তা না দিয়ে গোপন করেছে। আর তার জন্য ও কি ভুগছে না? আইসিসির শাস্তির পর ওর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। বলল, দোষ আমি করেছি। সব দায় আমার। ভুগতেও হবে আমাকে। প্রচন্ড হতাশ ও। সবচেয়ে হতাশ এটা ভেবে যে, এক বছর ক্রিকেট খেলতে পারবে না। অপরাধ করেছে, শাস্তি পেয়েছে, সব মেনে নিয়েছে সাকিব। শুধু মানতে পারছে না এক বছরের জন্য জীবন থেকে ক্রিকেট চলে যাওয়া!

কোথায় সেই যন্ত্রণাটা নিয়ে একটা লেখাও তো দেখলাম না কোথাও? দেশের কথা ভেবে আর একটু হলে যখন আঙুল হারাতে বসেছিল সাকিব, একটা লেখাও তো দেখিনি ওর দেশপ্রেম নিয়ে? গত এশিয়া কাপ আঙুলে চোট নিয়ে খেলেছিল সাকিব। এতটাই খারাপ অবস্থা হয়েছিল শেষ দিকে যে বাধ্য হয় দেশে ফিরে অস্ত্রোপচার করাতে। ডাক্তার বলেছিল ওকে, আপনি আর দু’টো দিন দেরি করলে বাঁ হাতের আঙুল বাদ দিতে হতে পারত! অর্থাৎ, ওর ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যেতে পারত! দেশের জন্য এত বড় ঝুঁকি নেয় ক’জন?

আমি জানি, এরপরেও সাকিব কোন দিন মাশরাফি হতে পারবে না। সাকিব নিজেও সেটা জানে। মাশরাফি বিন মর্তুজার যে লার্জার দ্যান লাইফ ভাবমূর্তি আছে বাংলাদেশে, সেটা কখনো হবেনা সাকিবের। সাকিব কোনদিন ম্যাশের মতো নিজের ঘরে সাংবাদিক, লোকজন ডেকে আড্ডা মারতে পারবে না। বলতে পারবে না, “দাদা আসেন, বসেন।” কী করা যাবে? মানুষ দু’টো তো আলাদা। মাশরাফি আমুদে। সাকিব অন্তর্মুখী।

তাই বলে কি সাকিব আড্ডা দেয় না? একশোবার দেয়। তবে নিজের চেনা লোকের সঙ্গে। সাকিব কি মাশরাফির মতো সহজ-সরল নয়? একশোবার সহজ-সরল। আমি গভীরভাবে মিশে দেখেছি তো, তারকাসুলভ কোন বায়নাক্কা ওর নেই। খেতে ভালবাসে। ইলিশ মাছ আর ভাত পেলে আর কিচ্ছু লাগে না ওর। কলকাতায় এসে কতবার আমাকে বলেছে, চলো একটু ভালো ইলিশ খেয়ে আসি! মিষ্টি অতো ভালবাসে না। তবে নানারকম ডিশ ট্রাই করে।

আসলে কি জানেন, সাকিব চুপচাপ থাকে বলে লোকে ভুল বোঝে। মিডিয়া ভুল বোঝে। মিডিয়াকে এড়িয়ে থাকে বলে সাকিবের ‘বদনাম’ আছে। কিন্তু সাকিব যে বেশি কথা বলতে চায় না, তাঁর কারণ আছে। অনেক বার হয়েছে যখন ও কথা বলেইনি, অথচ মিডিয়া ওর মুখে বসে চালিয়ে দিয়েছে! অথচ মিডিয়ার ওপর ওর যে রাগ আছে, তা কিন্তু নয়। সাকিব অনেকবার বলেছে, ‘আমি ভাল খেললে এই মিডিয়াই আমাকে নিয়ে দারুণ লেখা লেখে।’ শুধু একটা জিনিস খারাপ লাগে ওর। ধারাবাহিকতার অভাব। বলে যে, আজ ভাল লিখলো, কাল আবার মাটিতে নামিয়ে দিল। ভাল লেখাটা চালিয়ে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই আদতে লাভ। নিজের নামে খারাপ রিপোর্ট দেখে সাকিবকে বলতে শুনেছি, ‘লিখেছে যখন আর কি করা যাবে? আমাকে জানলে, চিনলে, আমার সঙ্গে মিশলে লিখত না।’

আমারও ঠিক একই বক্তব্য। সাকিব আল হাসানকে জানলে, চিনলে ঠিক পাশের বাড়ির ছেলে মনে হবে। একটা লাইনও পাওয়া যাবে না ওর বিরুদ্ধে লেখার মতো। প্রথমত, ক্রিকেট নিয়ে এত ভালবাসা আমি খুব কম ক্রিকেটারের মধ্যে দেখেছি। বছরের শুরুতে যখন ক্রিকেট সূচি বার হয়, সাকিব অবধারিত আমার সঙ্গে বসে পড়বে। বিশ্বের কোন লিগ খেলা যায়, বাংলাদেশের খেলার সঙ্গে লিগের খেলা এক সময় পড়েছে কি না, আগাম ছকে নেয়। আমি কোনও দিন দেখিনি প্রেস কনফারেন্সে কি বলবে, তা নিয়ে ভাবছে। বরং ভেবেছে আমি কী করলে আরও খেলার সুযোগ পেতে পারি?

বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়েও প্রচুর ভাবতে দেখেছি সাকিবকে। মনে আছে একবার বলেছিল, বাংলাদেশে ব্যাট তৈরির কারখানা যদি তৈরি করা যায়, সবচেয়ে ভাল হবে। ভাল ব্যাটের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশেই ব্যাট তৈরি হলে উঠতিদের হাতে ব্যাট আরও সহজে আসবে।

নানা বিষয়ে আগ্রহ দেখেছি। স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কিভাবে চলে, ওর নিজের রেস্তোরা কেন চলল না- সবকিছু নিয়ে কথা হয়। এখন বছরকয়েক হল ক্রিকেটের বাইরের সময়ের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে ওর মেয়ে। মেয়ে কখন খেল, কখন ঘুমোল, শরীর খারাপ করল কি না- সব সময় খোঁজখবর করে। মেয়েকে প্রচণ্ড ভালবাসে সাকিব। ঠিক যেমন ভালবাসে নিজের সতীর্থদের। কখনও দেখিনি কোন লিগ খেলতে গিয়ে নিজের তারকাসুলভ ভাবমূর্তি ব্যবহার করছে। বরং সবার সঙ্গে হইহুল্লোড় করে বেড়ায়। অনেককে সাহায্যও করে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার সময় অনেক ক্রিকেটার ওকে এসে বলে, সাকিব-ভাই এটা করে দাও, ওটা করে দাও। একটা ভাল ব্যাট দাও। সব নির্দ্বিধায় করে দেয়, দিয়ে দেয়।

আমি যখন স্পোর্টস ম্যানেজমেট কোম্পানি শুরু করি, সাকিবের ব্যাট চুক্তিটা করতে গিয়েছিলাম। তখন আমাকে কেউ চেনে না। একটা নামী সংস্থাও সাকিবের ব্যাট কন্ট্র্যাক্ট করাতে গিয়েছিল। কিন্তু সাকিব আমার সঙ্গেই চুক্তিটা করে। যা না করলেও ওর চলত। আজও যখন অন্যান্য ক্রিকেট এজেটদের সঙ্গে দেখা হয় আমার, সাকিবের এজেন্ট শুনে ওরা বলে, তুমি ভাগ্যবান। সাকিবের মতো ভদ্র, মার্জিত ক্রিকেটারকে তুমি ম্যানেজ করো।

তাই বলছি, সাকিব আল হাসান নিয়ে বলার আগে, দুমদাম লেখার আগে, নিজের মতামত পেশ করার আগে ওর সঙ্গে মিশুন। জানুন। চিনুন। বাজি রেখে বলতে পারি সেই সাকিব আল হাসানকে খুঁজে পাবেন না যাকে দুনিয়া চেনে। পাবেন তাকে, যাকে আমি চিনি।

লেখকের পরিচয়ঃ

রুদ্রদ্বীপ ব্যানার্জি,
পার্টনার, সেকেন্ড ইনিংস স্পোর্টস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট
সাকিব আল হাসান সহ তামিম ইকবাল, লিটন দাস, ইমরুল কায়েস, সাব্বির রহমান ও আবু হায়দার রনির এজেন্ট।

৯৭ প্রতিবেদক

Read Previous

বৃষ্টি বাঁচিয়ে দিল নতুন নেতৃত্বে মাঠে নামা পাকিস্তানকে

Read Next

অভিষেকের অপেক্ষায় মোহাম্মদ নাইম

One Comment

  • Shakib Al Hasan is our hero..He is our legend..The real tiger of Bangla Cricket..A true patriot..We are proud to get such a legendary cricketer..We love him..I hope he will come back strongly and give lots of performances to our team..Good luck champ for the future..Love u a lot boss..The ultimate hero..
    #SAH75

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Total
0
Share