

একজন লেগ স্পিনারের খোঁজে দিশেহারা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নির্বাচকরা। যদিও আসলেই দিশেহারা কিনা এ নিয়ে রয়েছে বেশ সংশয়। নইলে বাংলাদেশের জার্সিতে প্রথম বিশেষজ্ঞ লেগ স্পিনার হিসেবে খেলা জুবায়ের হোসেন লিখন কেন পাচ্ছেন না কোন পর্যায়েই সুযোগ? চলতি মৌসুমে আন্তর্জাতিক, বয়সভিত্তিক, ‘এ’ দল মিলিয়ে ব্যস্ততায় ঠাঁসা সূচী বাংলাদেশের জাতীয় দল ও পাইপ লাইনের ক্রিকেটারদের।
একদিনের ব্যবধানে অনূর্ধ্ব ২৩ ও ‘এ’ দল দেশ ছেড়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে। দিন কয়েক আগে শ্রীলঙ্কা ইমার্জিংয়ের বিপক্ষে খেলেছে হাই পারপফরম্যান্স দল। অথচ এতগুলো জাতীয় দল তৈরির মিশনে সুযোগই মিলেনি ২৪ বছর বয়সী জুবায়ের হোসেন লিখনের। বয়স ২০ হওয়ার আগেই খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে ৬ টি টেস্ট, গায়ে চাপিয়েছেন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি জার্সিও।
২০১৪ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের একবছর পরই বাদ, ২০১৫ সালে খেলেছেন সবশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এরপর আর সুযোগ পাননি জাতীয় দলের জার্সিতে, মূলত তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিং এর পছন্দের পাত্র হতে পারেননি বলেই ফেলা হয়েছে বাদের তালিকায়, এমন একটি গুঞ্জনও উঠেছিল বেশ ভালোভাবে।
তবে শুধু জাতীয় দলেই যে নির্বাসিত তা নয়, লেগ স্পিনার বলে ঝুঁকি নিতে চায়না ঘরোয়া লিগের দললগুলোও। এমনকি কোটি টাকা খরচায় দল গড়া বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোও দলে ভেড়ায়নি জুবায়ের হোসেনকে, ২০১৬ সালে চিটাগাং ভাইকিংস দলে নিলেও খেলায়নি কোন ম্যাচ। আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেট কাঠামোতেই কখনো বাড়তি সুবিধা পায়নি লেগ স্পিনাররা।

ব্যবসায়িক চিন্তায় গড়ে ওঠা দলগুলো লেগ স্পিনারদের নিয়ে ঝুঁকি নিতেই রাজি নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটে যে লেগ স্পিনার আসেনি তা কিন্তু নয়। যথাযথ পরিচর্যা আর গুরুত্ব না বঝার কারণে জাতীয় দলতো দূরে থাক ঘরোয়া ক্রিকেটেই নিমিষে হারিয়ে গেছেন সেসব লেগ স্পিনাররা। তাদেরই একজন নুর হোসেন মুন্না। বর্তমান বয়স মাত্র ২৬ , সবশেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন ২০১৬ সালে। ২৬ প্রথম শ্রেনির ম্যাচেই তুলে নিয়েছিলেন ৮০ উইকেট। এরপর নিজের বেখেয়ালিপনা হোক আর সঠিক নজরদারির অভাবে হোক নুর হোসেনের অস্বতিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা বাংলাদেশ ক্রিকেটে।
তারও আগে ফিরে গেলে পাওয়া যায় রায়হান উদ্দিন আরাফাতকে, যিনি ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করেন অথচ ২০১৬ সাল পর্যন্ত পেশাদার ক্রিকেটের সাথে জড়িত থাকার পরেও খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৬ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। তার ক্ষেত্রেও ঘটনা একই, দলে নেওয়ার আগ্রহই দেখাতনা কোন দল। মূলত লেগ স্পিনারদের ভবিষ্যত অন্ধকারই ভাবা হত ওই সময়টায় ফলে অঙ্কুরেই নষ্ট হত লেগ স্পিনারদের স্বপ্ন। অথচ বয়স ভিত্তিকে সাকিব-মুশফিকদের সাথেই খেলেছেন আরাফাত।
সাকিব-মুশফিকদের কথা আসলেই আরেকজনের নাম নিতেই হয়। হুমায়ুন কবির শাহীন, বয়সভিত্তিকে থাকাকালীন সাকিব, মুশফিক, তামিমদের সাথে খেলেছেন নিয়মিত। কিন্তু সময় গড়াতেই লেগ স্পিনার শাহীনের হয়েছে অবনতি অন্যদিকে সাকিব, মুশফিকরা আজ বিশ্ব তারকা। তবে এক্ষেত্রে নিজের চাইতে সঠিক পরিচর্যার অভাব ও অবহেলাকেই দায়ী করছেন তিনি। তার আক্ষেপ যদি বাঁহাতি স্পিনার হতেন তবে জাতীয় দল না হউক অন্তত ঘরোয়া লিগে খেলতে পারতেন নিয়মিতই।
তার কথার বাস্তব প্রমাণও মেলে পরিসংখ্যান ঘাঁটলে, ২০০৬ সালে প্রথম শ্রেণির অভিষেকের পর খেলতে পেরেছেন মাত্র ১০ টি ম্যাচ। ক্লাব ক্রিকেটেও পেতেননা দল, অথচ ওই সময়টায় বেশ রাজত্ব করেছে বাঁহাতি স্পিনাররা। জাতীয় দলে ডাক পেতে বাঁহাতি স্পিনের সাথে টুকটাক ব্যাটিং পারলেই যেন পাইপলাইনে নিশ্চিত। মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান , মানজারুল ইসলাম রানা, এনামুল হোক জুনিয়র, মেহরাব হোসেন জুনিয়র, সোহরাওয়ার্দী শুভরা তার অন্যতম নজির।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব ক্রিকেটে লেগ স্পিনারদের দাপট দেখে কিছুটা টনক হয়তো নড়েছে বোর্ড সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু সবশেষ আমিনুল ইসলামের ত্রিদেশীয় সিরিজে ডাক পাওয়াটাও বড় চমকই বলতে হয়। মূলত ব্যাটসম্যান আমিনুল হাই পারফরম্যান্স কোচ সাইমন হেলমেটের চোখে ধরা পড়েছেন লেগ স্পিন বিস্ময় হিসেবে। আর তার জের ধরেই জাতীয় দলের কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোর কাছ থেকে দেখতে চাওয়া তাকে সুযোগ করে দেয় জাতীয় দলের স্কোয়াডে।
তবে এরপরও ওঠে প্রশ্ন, কোচের চাওয়াতেই আমিনুল দলে অথচ এই ভাবনাটাই কেন নির্বাচকদের মাথা থেকে আসেনি? কোচের চাওয়ার আগেই কি তরুণ রিশাদ হোসেন, বিপিএল দিয়ে উত্থান হওয়া মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি , জাতীয় দলের হয়ে খেলা অভিজ্ঞ জুবায়েরকে নিয়ে আলাদা কাজ করতে পারতনা বিসিবি?
রিশাদ ইতোমধ্যে বোর্ডের অধীনে খেলছেন, জুবায়ের হোসেনকেও আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের আগে দুদিনের প্রস্তুতি ম্যাচে সুযোগ দিয়েছে বোর্ড, আমিনুলকে পাঠানো হচ্ছিলো বিভিন্ন দেশে বোর্ডের অধীনে যাওয়া দলগুলোর সাথে। যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার, তবে এই নজরদারিরর জায়গাটা আরও গভীর হলে হয়তো এতদিনে আক্ষেপ গুছতো একজন লেগ স্পিনারের।