

অসাধারণ পারফরম্যান্সে বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ের ফলে পয়েন্ট টেবিলের ৫ম স্থানে উঠে এসেছে তারা। আর এই জয়ে ব্যাটে-বলে দলকে পথ দেখিয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তুলে নিয়েছেন নিজের ৯ম আর এই বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, এর আগে বল হাতেও ৫৪ রানে তুলে নিয়েছেন ২ উইকেট। তার এমন অনবদ্য পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে আরো বড় কিছুর। আর সেটা যে স্বপ্নের সেমিফাইনাল, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রিত বোলিং করছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। অসাধরণ সুইংয়ের ফাঁদে ফেলে সাইফউদ্দিন নতুন বলেই তুলে নিয়েছিলেন ক্রিস গেইলের উইকেটটি। এরপর এভিন লুইস আর শাই হোপ যখন ১১৬ রানের জুটি গড়ে ক্রমশ বিপদজনক হয়ে উঠছিলেন, তখনই বল হাতে দলকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন সাকিব। ফেরান ৭০ রানে ব্যাট করতে থাকা এভিন লুইসকে। কিছুক্ষণ পরেই নিকোলাস পুরানকেও ফেরান তিনি। ৮ ওভার হাত ঘুরিয়ে তার বোলিং ফিগার ২/৫৪। মাঝে মুস্তাফিজ একই ওভারে হেটমেয়ার ও রাসেলকে ফেরালে চাপে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মুস্তাফিজ নিয়েছেন ৩ উইকেট। আর তরুণ অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিন একটু খরুচে বোলিং করলেও তিনিও তুলে নিয়েছেন ৩ উইকেট। ৫০ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩২১/৮।
উদ্বোধনী জুটিতে ৫২ রান যোগ করার পর আউট হন সৌম্য সরকার। তার বিদায়ের পর উইকেটে আসেন সাকিব। ইনিংসের শুরু থেকেই উইকেটের চারপাশে দুর্দান্ত সব স্ট্রোকের পসরা সাজিয়ে বসেন সাকিব। ২য় উইকেট জুটিতে তামিম-সাকিব এরপর আরো যোগ করেন ৬৯ রান। শেলডন কটরেলের দুর্দান্ত থ্রোতে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিতে থাকা তামিম আউট হয়ে ফেরার পর মুশফিকও তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলে উইকেটে আসেন এবারের বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা লিটন কুমার দাস। সাকিবকে সঙ্গ দিতে শুরুতে লিটন একটু সাবধানী শুরু করলেও ওপ্রান্তে সাকিব ছিলেন নির্ভীক। এরপর লিটনও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলে দুজনে মিলে রীতিমতো শাসন করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের। তাদের ১৮৯ রানের অবিছিন্ন জুটিতে ভর করেই ৫১ বল হাতে রেখে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। ভাল বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতে অবিস্মরণীয় ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হয়েছেন সাকিব।
হ্যাঁ, এই জয়ে অবদান অবশ্যই গোটা দলের। তবে স্ট্যান্ড-আউট পারফর্মার সেই সাকিব-আল-হাসানই। শুধু এই ম্যাচটিই নয়, বিশ্বকাপের এবারের আসরের শুরু থেকেই তার ব্যাটে ছুটছে রানের ফোয়ারা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫ আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৪ রানের হাফ-সেঞ্চুরি দুটিতে ছিল বড় কিছুর আভাস। ৩য় ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যেদিন বাংলাদেশ দল মাঠ ছেড়েছিল মাথা নিচু করে, সেদিনও ব্যাট হাতে লড়েছেন একাই। তুলে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপে তার প্রথম সেঞ্চুরিটি। করেছিলেন ১১৯ বলে ১২১ রান। পরের ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায় মাঠে নামা হয়নি তার। আর গতকাল তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ইনিংস।
খুব ভালভাবে যদি লক্ষ্য করা যায়, তবে সাকিবের ব্যাটিংয়ের কিছু বিষয় চোখে পড়বে। সব থেকে বড় ব্যাপার যেটি, ফিটনেস নিয়ে বিশ্বকাপের আগে কাজ করাটা তার পক্ষে সাড়া দিয়েছে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে। গত পরশুর ইনিংসের কথাই যদি ধরা হয় তবে দেখা যাবে, ৯৯ বলে খেলা ১২৪ রানের ইনিংসে সাকিব চার মেরেছেন ১৬টি। ছক্কা নেই একটিও। অর্থাৎ মোট ১২৪ রানের ৬৪ রান এসেছে বাউন্ডারি থেকে। বাকি ৬০ রান তিনি নিয়েছেন দৌড়ে। এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট সাকিবের ফিটনেস বোঝাতে। দারুণ রানিং বিট্যুইন দ্যা উইকেটসে সার্কেলের ভেতর থেকে নিয়েছেন অনেক বুদ্ধিদীপ্ত সিঙ্গেল, সার্কেলের সামান্য বাইরে থেকে নিয়েছেন কিছু ডাবলসও।


এরপর আসে বিহাইন্ড দ্য স্কয়ারে খেলা শটগুলো। ডিপ থার্ডম্যান আর ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের ফাঁকগুলোতে ঠেলে রান তোলাতেও তিনি দেখাচ্ছেন যথেষ্ট মুনশিয়ানা। বেশি গতির বলগুলোকে সেই গতি ব্যবহার করছেন দারুণভাবে। অবশ্য গত ইনিংসে মাঠের কোন পাশে শট খেলেননি তিনি! প্রতিপক্ষ অধিনায়ক হোল্ডারকে অসহায় বানিয়ে একের পর এক খেলে গেছেন চমৎকার সব শট। স্ট্রেইট ড্রাইভ, পুল-হুক, কাভার ড্রাইভ, ব্যাকফুট পাঞ্চ, স্কয়ার ড্রাইভ, কাট- ক্রিকেট ব্যাকরণের সব শটেই পরিপূর্ণ এক ইনিংস ছিল গতকাল সাকিবের খেলা এই ইনিংস। জেসন হোল্ডারকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে যে শটটি খেলে চার মেরেছেন বা ওশেন থমাসের বলে যে কাভার ড্রাইভে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন- এই শট দুটি দেখলেই বোঝা যায় ব্যাট হাতে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময় পার করছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, নির্ভীক ব্যাটিং দিয়ে একটিবারের জন্যেও দলকে পড়তে দেননি আস্কিং রেটের চাপে। অনায়াসেই নিয়েছেন সিঙ্গেলস, ডাবলস। সঙ্গী লিটন দাসকে তৈরি করে দিয়েছেন তার ইনিংসের শুরুটা দেখেশুনে করার। ম্যাচ শেষে লিটন তাই সেটার কৃতিত্ব দিয়েছেন সাকিবকে।
শুধু ব্যাটিং নয়, বল হাতেও সাকিব দলকে দিয়ে চলেছেন নির্ভরতা। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন অব্দি সাকিব বল হাতেই সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যতিক্রম হচ্ছে না এই বিশ্বকাপেও। বিশ্বকাপের এবারের আসরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছাড়া উইকেটের দেখা পেয়েছেন বাকি ৩ ম্যাচেই। সব মিলিয়ে এখন অব্দি সাকিব উইকেট পেয়েছেন ৫টি। করেছেন রান আটকে রাখার চেষ্টা করে যাওয়া বোলিং। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যাওয়া ম্যাচটিতেও দলকে নতুন বলে এনে দিয়েছিলেন ব্রেক-থ্রু। মানে এক কথায়, ব্যাট-বল দুটো হাতেই এই বিশ্বকাপ দেখছে অসাধারণ ধারাবাহিক এক সাকিবকে।
তবে আরেকটি ব্যাপার হয়তো চোখে পড়েছে ক্রিকেটবোদ্ধাদের। কিছু শর্ট বল সাকিবের ব্যাটের কানা ছুঁয়েও পেরিয়ে গেছে সীমানা কিংবা পড়েছে ফাঁকা জায়গায়। অন্য কোন দিনে হয়তো সেগুলো জমা পড়বে প্রতিপক্ষ ফিল্ডারদের হাতেই। তাই শর্ট বলের বিপক্ষে ব্যাটসম্যান সাকিবকে তাই আর খানিকটা হতে হবে সাবধানও।
এই বিশ্বকাপে বলা যায়, সাকিবেই উড়ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চারদিক এখন শুধুই তাই সাকিবময়। তবে ইতোমধ্যেই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দেখা ফেলা সাকিব জানেন তার প্রতিযোগিতা এখন কেবল তার নিজের সাথেই। তিনি জানেন, বোঝেন আর সেই সাথে করে চলেছেন তার কাজটি। বলা যায়, তিনি তার কাজ করে চলেছেন অবলীলায়, ধারাবাহিকতাকে সাথে নিয়ে। সেই নিজের সাথে প্রতিযোগিতায় সাকিব নিজেকে ছাড়িয়ে যান, পৌছে যান অনন্য কোন উচ্চতায়- এই কামনা এখন গোটা বাংলাদেশের। ইতিমধ্যেই এই বিশ্বকাপকে প্রায় নিজের করে নেয়া সাকিব পারবেন কি দলকে স্বপ্নের সেমিফাইনালে পৌছে দিতে? এই উত্তরের অপেক্ষাতেই এখন পুরো দেশ।