

দিক হারানো বাংলাদেশ নামক জাহাজটি যখন ক্রমশ তীর থেকে মাঝ সমুদ্রে দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে তখনই দৃশ্যপটে এক আনসাং হিরোর আগমন। ক্যারিয়ারে সামনের মাসেই যার পূর্ণ হবে এক দশক। কিন্তু এই এক দশকে কক্ষপথ থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে বারবার। সব অনিশ্চয়তাকে পাশ কাটিয়ে ফিরেছেন বারবার। ১১ মাস পর এবার যখনআবার দলে আচমকা ডাক পেলেন তখন চারিদিক থেকে ধেয়ে আসছিল সমালোচনার তীর। বাংলাদেশ থেকে বিমানে উড়ে গিয়ে ১৪০ কিঃমিঃ বাস ভ্রমনের পর মহা-গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বিশ্রাম না নিয়েই মাঠে নেমেই ব্যাট হাতে দিয়েছেন সকল সমালোচনার জবাব। তার ব্যাটেই দল পেয়েছে আফিগানিস্তানের বিপক্ষে কাঙ্ক্ষিত জয়টি। সেই সাথে বাঁচিয়ে দিলেন বাংলাদেশ দলের এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলার স্বপ্নকে।

দলের রান তখন ৪ উইকেটে ৮১। একটু আগেই ফিরে গেছেন দলের প্রাণ ভোমরা সাকিব আল হাসান। এবার ভুল বোঝাবুঝিতে সেট ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমের রান আউটে দল উপর ভর করেছের রাজ্যের নিরাবতা। সারা জীবন টপ অর্ডারে ব্যাট করলেও ইমরুল কায়েস নামলেন ছয় নম্বরে। ২১তম ওভারে মাহমুদউল্লাহ সাথে যাত্রা শুরু, যখন এই জুটি থামলেন তখন পেরিয়ে গেছে ৪৭ ওভার। ১২৮ রানের পার্টনারশিপ গড়ে দলকে বিপদ থেকে রক্ষা করে মাহমুদউল্লাহ যখন ফিরলেন দল তখন অনেকটা নিরাপদ লক্ষ্যের দিকে বাংলাদেশ দল। এই সময়ে এই জুটিতে নাম লেখান ৬ষ্ঠ উইকেটে দলের সর্বোচ্চ সংগ্রহের তালিকায় সবার উপরে। পিছলে ফেলেন ১৯৯৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গড়া আল শাহরিয়ার ও খালেদ মাসুদের ১২৩ রানের জুটি। দলের আড়াইশো রানের পুঁজিতে তার অবদান অপরাজিত ৭২ রান।
কিন্তু দু’দিন আগেও জানতেন না ভাগ্য বিধাতে তার জন্য এতোকিছু নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ছিলেন বাংলাদেশ এ দলের প্রস্তুতি ক্যাম্পে খুলনায়। ওখানে বসেই সংবাদ পেলেন এশিয়া কাপ খেলতে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে তাকে। প্রথম একটু চমকালেও নিয়েছিলেন গুরুত্বসহকারে। দলের যার আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকতে হয় তাই ম্যাচ খেলার সম্ভাবনা ছিলনা বললেই চলে। তামিমের শূন্যতা যেন পূরণ হচ্ছিল না তাই টিম ম্যানেজমেন্ট ডেকে পাঠিয়েছিলেন তামিমের দীর্ঘদিনের সঙ্গীর উপর। আর দীর্ঘ ভ্রমন ক্লান্তিকে পাত্তা না দিয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই বাজিমাত সব সময় পার্শ্ব নায়কের ভূমিকা পালন করা ইমরুল কায়েস।

সারা জীবন টপ অর্ডারে ব্যাট করা ইমরুল হঠাৎ কেন মিডিল-লোয়ার অর্ডারে? এটার কোন অফিসিয়াল ব্যাখ্যা না পেলে এটার পিছলে অনেকগুলো কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। গত কিছুদিন থেকে আফিগান জুজু ভর করেছিল বাংলাদেশের উপর। এই ম্যাচের আগে টানা চার ম্যাচে (তিন টি-টোয়েন্টি ও এক ওয়ানডে) তাদের বিপক্ষে হার। আফগান স্পিনার যেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের কাছে ধাঁধাঁর নাম। সবার আগে উঠে আসবে রাশিদ খানের নাম। মাঝের ওভারগুলোতে রীতিমতো ভয়ংকর তার বোলিং। মূলত তাকে সামলাতেই উপর থেকে ছয় নাম্বারে ইমরুলকে নামানো হয়। প্রথমে দারুণ ছন্দে থাকা মাহমুদউল্লাহকে সঙ্গ দিয়ে গেলেন। ১২৮ রানের জুটি গড়ার পথে সেই রাশিদকেই কাউন্টার অ্যাটাকে গেলেন এই দু’জন ব্যাটসম্যান। আর তাতেই মেজাজ হারালেন এই লেগী। আর কিস্তিমাত বাংলাদেশের।
খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে মাহমুদউল্লাহ ৮১ বলে ৭৪ রান করে ফিরে গেলেও দলের স্কোর আড়াইশো রানের কোটায় পৌছাতে শেষ পর্যন্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে লড়েছেন এই পার্শ্বনায়ক। দীর্ঘ ভ্রমন ক্লান্তি বারবার উকি দিচ্ছিল। কিন্তু দলের জন্য অন্তপ্রাণ যোদ্ধা এত সহজেই হাল ছাড়বার পাত্র নয়। চেষ্টা চালিয়ে গেছেন শেষ বল পর্যন্ত। তার অপরাজিত ৭২ রানে ভর করে শেষ ওভারে ম্যাজিক দেখিয়ে ম্যাচ জেতানোর সাহস দেখিয়েছেন মুস্তাফিজরা। এবারও হয়তো তাকে পার্শ্ব নায়ক হয়েই থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এই নায়কেরা দলের জন্য নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও চেষ্টা করে যান, এর ঠিক এক ম্যাচ পরেই এই সব আনসাং হিরোদের অবদান ভুলে যাবে সবাই। কিন্তু ইতিহাস তার রাজ সাক্ষী হয়ে অনন্তকালের জন্য লিখে রাখবে তাদের অবদান।