

পশ্চিম বঙ্গের মানুষতো বটেই, সবখানেই ‘দাদা’ বলেই খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলি। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম বাঙ্গালি অধিনায়ক ও অসংখ্য রেকর্ডের জন্মদাতা। ভারতীয় ক্রিকেটে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম সৌরভ গাঙ্গুলি। ভালোবেসে কেউ তাকে ‘প্রিন্স অব কলকাতা’ ডাকেন। কেউ আবার তার বিস্ময়কর দক্ষতার জন্য ‘ঈশ্বর’ বলেও ডাকতেন! অধিনায়ক হিসেবে তার তুলনা তিনি নিজেই। আর বাইশ গজের পিচে নিঃসন্দেহে সৌরভ গাঙ্গুলি সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকার একজন।
১৯৭২ সালের ৮ জুলাই কলকাতার বেহালাতে জন্মগ্রহণ করেন সৌরভ চণ্ডীদাস গঙ্গোপাধ্যায়।
বেঙ্গল টাইগারের লেজটা তো সবসময় উঁচুই থাকে, যেন শিকারের জন্য ওত পেতে আছে- এই বাক্যটার উদাহরণ শুধু সৌরভ গাঙ্গুলি। সৌরভ এমন একজন ক্রিকেটার, যাকে বিশ্বের যে কোনও অধিনায়ক নিজেদের দলে রাখতে চাইবে। সৌরভ গাঙ্গুলির মধ্যে এই ক্ষমতা ছিল যে ওর শট শুধুমাত্র মাঠের ভিতর বাউন্ডারির দড়িটাই অতিক্রম করত না, কখনও কখনও স্টেডিয়ামও টপকে যেত। স্পিনারদের বিরুদ্ধে সৌরভ গাঙ্গুলি ছিল ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভগবান।
একটা সময় সৌরভ গাঙ্গুলির সৌরভে মাতোয়ারা হয়ে ছিল ক্রিকেট বিশ্ব, সে মুগ্ধতা আজও কমেনি, কমবে না কখনো!
গাঙ্গুলির স্বপ্নযাত্রা!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেকটা হয় খুবই বাজেভাবে। ১৯৯২ সালে ২০ বছর বয়সে, ভারতের ওয়ানডে দলে ডাক পান গাঙ্গুলি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দুঃস্বপ্নের অভিষেক ম্যাচে মাত্র ৩ রানই করতে পেরেছিলেন তিনি!
১৯৯৬ সালে লর্ডসে সৌরভ গাঙ্গুলির টেস্ট অভিষেক হয়। অভিষেক টেস্টেই তিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন। ‘ক্রিকেটের মক্কা’ খ্যাত ইংল্যান্ডের লর্ডসে সেঞ্চুরি করে ‘অনার্স বোর্ড’ এ নাম লেখানোর স্বপ্ন থাকে প্রত্যেক ক্রিকেটারের। এই স্বপ্ন যেখানে শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা আর রিকি পন্টিংয়ের মতো রথী-মহারথীরা পূরণ করতে পারেননি, সেখানে অভিষেক টেস্টেই লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখান গাঙ্গুলি। খেলেন ১৩১ রানের ঝলমলে একটি ইনিংস। এমন স্বপ্নীল অভিষেকের পরের ম্যাচেই, ট্রেন্ট ব্রিজে খেললেন ১৩৬ রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস।
অধিনায়ক সৌরভ
২০০০ সালে তিনি মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব পান এবং অধিনায়ক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন সৌরভ গাঙ্গুলি। অধিনায়ক হয়ে যেন তিনি বড় ম্যাচের খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। প্রায় প্রত্যেক ম্যাচেই দেখা যেত বিধ্বংসী আর ভয়ানক গাঙ্গুলিকে। এই বাঙালি ক্রিকেটারের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিলো ‘টিম ইন্ডিয়া’। অধিনায়ক থাকা কালে ৪৯ টি টেস্ট ম্যাচের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি যার মধ্যে ২১টি ম্যাচ জিতেছিল। ভারতকে ২৮টি অ্যাওয়ে টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১১টিতেই জিতিয়েছেন। যা তৎকালীন ভারতের অধিনায়ক হিসেবে অন্যতম একটি রেকর্ড। তিনি ছিলেন ভারত ইতিহাসের একজন সফল অধিনায়ক। ১৪৬টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে ৭৬টি ম্যাচ জিতেছিল সৌরভ।
ভারত দলকে দেশের বাহিরে কীভাবে জিততে হয় সেটা সৌরভই শিখিয়েছিল। তার আগ্রাসী ব্যাটিং ও ভয়ডরহীন অধিনায়কত্বের জন্য ভারতের ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন উচ্চতা পেয়েছিল। শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, হরভজন সিং, ভিভিএস লক্ষণ, বীরেন্দ্র শেবাগ, যুবরাজ সিংয়ের মতো বিশ্বজয়ী তারকারা তার নেতৃত্বেই দীর্ঘদিন ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করেছেন ব্যাটে-বলের কারিশমাতে।

লর্ডসের বেলকোনিতে সৌরভ গাঙ্গুলীর উদযাপন তো ক্রিকেট ইতিহাসেরই অংশ। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর জার্সি খুলে বিজয়দর্পে ঘুরিয়েছিলেন অধিনায়ক সৌরভ। সেই দৃশ্য ক্রিকেট ভক্তদের মন থেকে কখনোই মুছে যাবার নয়।
১৯৯২-২০০৮
১১৩টি টেস্ট খেলে তিনি ১৬ সেঞ্চুরি আর ৩৫ ফিফটিতে সর্বমোট ৭ হাজার ২১২ রান করেছেন। আর ৩১১ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে করেছেন ১১ হাজার ৩৬৩ রান। ওডিআই ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরি ছিল ২২টি আর হাফসেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ৭২বার। তার নেতৃত্বে ২০০২ সালে ভারত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০৩ সালে তিনি ভারতকে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলেন। ১৯৮৩ সালের পর সেই প্রথম ফাইনালে উঠেছিল ভারত। ক্যারিয়ারের শেষ বছরটা টেস্ট এবং ওডিআই, উভয় ফরম্যাটেই দুর্দান্ত কাটে তার। অথচ এমন দুর্দান্ত ফর্মে থেকেও ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের পর, আর কোনোদিন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি তার। ২০০৮ সালে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ হারার পর টেস্ট ক্রিকেট থেকেও অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয় তার।
‘সৌরভ আমার পছন্দের ক্রিকেটার। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ও যেভাবে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তা আজও আমাকে বিস্মিত করে। ওর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে’
-ব্রায়ান লারা