

২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ পর্যন্ত শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর চলছিল নিজের নিয়মেই। সেই দর্শনার্থীদের ভীড়, কর্মচারীদের রোজকার কাজ আর ব্যস্ততায় সবাই ব্যস্ত ছিল নিজের মতই। ২৪শে সেপ্টেম্বর থেকে সবই ছিল একই রকম তবে যোগ হয়েছিল নতুন এক উন্মাদনা, বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জাদুর ঘরটায় বসেছিল অন্যরকম এক জাদুঘর!
বাংলাদেশ ক্রিকেট ফেস্টিভ্যাল-২০১৭’র আয়োজনটা আগের রাত থেকেই শুরু। ক্রিকেটের নানা স্মারক, আর বিরল সব সংগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) এক ঝাঁক তরুণ জাদুঘর প্রাঙ্গণ মুখরিত করেছিল শনিবারের রাত থেকেই। উদ্দেশ্য একটাই, দেশের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষগুলো যেন নিজের দেশের ক্রিকেটের অতীত আর বর্তমানটা নিজ চোখে অবলোকন করতে পারে একই ছাদের নিচে।
জাদুঘরের ঠিক আড়াইতলায় স্মারক আর ক্রিকেটীয় সংগ্রহের পসরাটা সাজিয়েছিল বিসিএসএ। দরজা ধরে একটু বামদিকে এগোলেই সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিমের বিশাল সংগ্রহশালাটা চোখে পড়বে সবারই। ক্রিস গেইল, শিব নারায়ন চন্দরপল আর শ্রীলঙ্কান ব্যাটিং কিংবদন্তী কুমার সাঙ্গাকারার অটোগ্রাফওয়ালা ব্যাটগুলো দেখেই আপনি যদি আরেকদিকে চলে যেতেন তবে ভুল করতেন!
ব্যাটগুলোর সামনেই রয়েছে উইলো হাতে বিশ্ব শাসন করা দুই ব্যাটসম্যান শচীন রমেশ টেন্ডুলকার আর ব্রায়ান চার্লস লারার ব্যবহৃত গ্লাভস, তাদের স্বাক্ষরটা জ্বলজ্বল করছে যার উপরে।
এবার সেই টেবিল থেকে আরেকটু বামে আসলেই চোখে পড়বে বাংলাদেশের চার ব্যাটিং স্তম্ভ মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম এবং তামিম ইকবালের অটোগ্রাফকৃত ছোট্ট চারটি ব্যাট।
তারপাশেই একটা সময়ে যে পাকিস্তানী পেস বোলার যুগলকে বলা হতো ‘দ্য ডেডলি ড্যু’ সেই ‘টু ডব্লিউ’ খ্যাত ওয়াকার ইউনুস এবং ওয়াসিম আকরামের জোড়া স্বাক্ষরিত বল। সামনেই ক্রিকেট ইতিহাসের সন্দেহাতীত দুই সেরা ঘুর্ণিবলের জাদুকর মুত্তিয়া মুরালিধরন এবং শেন ওয়ার্নের দুটি বল, নিঃসন্দেহে অটোগ্রাফসহ!
অ্যাশেজের ছোট্ট ঐ ট্রফিটার একটা অবিকল প্রতিরুপও ছিল ক্রিকেটের উৎসবটিতে। আর অ্যাশেজের কথা যেহেতু চলে এসেছে সেহেতু অস্ট্রেলিয়াসহ পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই ব্যাটিং কিংবদন্তী স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের কথা চলে আসবেই। সেই ভাবনা থেকেই একটা পাশ দখল করেছিলেন ‘স্যার’। ডাকটিকিটের ডন ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে প্রদর্শনীর একটা দেয়াল বরাদ্দ। অবাক চোখে সেই ডাকটিকেটগুলো দেখেছেও দর্শকরা।
তবে, প্রদর্শনীটির মধ্যমণি হয়েছিলেন একজন মানুষ, যিনি নেই এই পৃথিবীতেই। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়েই তখন যুদ্ধের ডামাডোল বাজছে, সবাই যোগ দিচ্ছে যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন আরও একজন। কাউকে কিছু না বলে ঘর ছাড়ার আগে যিনি তার মাকে বলেছিলেন ” আমি যখন থাকব না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।”
মাঠে দুর্দান্ত সব ড্রাইভে প্রতিপক্ষকে চূর্ণ-বিচুর্ণ করে দেয়া একজন ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। তবে, র-ণ-সাজেও কম যাননি। ঢাকার ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী সহ একাধিক এলাকায় অতর্কিত হা-ম-লায় দিশেহারা করে দেন পাক সেনাদের। খুব চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে উদ্বোধন করতে নামবেন প্রিয় স্লেজেনজার-কলিন কাউড্রি ব্যাটটি নিয়ে।
তেমনটা হয়নি, গেরিলা অপারেশন থেকে নৌপথে ফেরার সময় রাজাকার ও পাক-বাহিনীর অতর্কিত বু-লে-টে-র আ-ঘা-তে তার হাতের তিনটি আঙ্গুলে মা-রা-ত্ম-ক জখম হয়েছিল। অথচ তার মনে প্রশ্নটা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে এই জ-খ-মী আঙুল নিয়ে মাঠে নামতে পারবেন তো?
পারেননি বীর বিক্রম খ্যাতিতে ভূষিত হওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। নিজে পারেননি তো কি হয়েছে, সাকিব-তামিমদের দিয়ে গিয়েছেন স্বাধীন দেশ! তাই তার স্মৃতিতে বিসিএসএ প্রদর্শনীতে রেখেছিল তারই ব্যবহৃত সেই স্লেজেনজার-কলিন কাউড্রি ব্যাটটি। এ প্রজন্মের অনেকেই যার কারণে সাক্ষী হতে পেরেছে ‘জুয়েল’ নামের ইতিহাসের।
বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের স্মরণীয় সব ম্যাচের টিকিট ছিল ক্রিকেটারদেরই অটোগ্রাফসহ। প্রথম ওয়ানডে জয় থেকে শুরু করে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়, প্রথম টেস্ট জয়ের টিকিটগুলো ছিল যত্নের সাথেই। ছিল নিউজিল্যান্ডের মাঠে সাকিব আল হাসানের দুর্দান্ত সেই দ্বিশতকের ম্যাচ টিকিটটি, সাকিবেরই অটোগ্রাফসহ। তামিম ইকবালের ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুই সেঞ্চুরি, আর লর্ডসের সেই অনবদ্য শতকের ম্যাচ টিকিটগুলোও তামিমের স্বাক্ষর সহ সাজানো ছিল কাঁচের ফ্রেমে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট ফেস্টিভ্যালের আগের দুই আসর বসেছিল ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে ধানমন্ডির দৃক গ্যালারীতে। সেই দুই আয়োজন থেকে এবারের আয়োজন খানিকটা ভিন্নই হয়েছে বলা চলে একটি আলাদা এবং বৈচিত্রপূর্ণ আয়োজনের জন্যে। এর আগে বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি এমনটা।
দেশের সব অনলাইনভিত্তিক সমর্থকগোষ্ঠী মিলিত হয়েছিল একই ছাদের নিচে। কর্মশালাটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘ক্রিকেট অনলাইন কমিউনিটি সামিট, বাংলাদেশ ২০১৭’। দেশ সেরা দশ ক্রিকেট গ্রুপকে নিয়ে আসা হয়েছিল আমন্ত্রণ করে। জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে তারা উপস্থাপন করেছে নিজেদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য, সবাইকে জানিয়েছে নিজেদের উঠে আসার গল্প।
বিশ্বের আর কোন দেশে ক্রিকেট অনলাইন কমিউনিটি’র এতো গুলো গ্রুপের এডমিনদের অংশগ্রহনে এমন আয়োজন হয়েছে বলে প্রমাণ মিলছেনা। দৌড়া বাঘ আইলো, ক্রিকপ্লাটুন, ক্রিকেট আড্ডা, ক্রিকেট ফিয়েস্তা, ফ্যানস অফ সাকিব আল হাসান ৭৫, ক্রিকেটখোর, ১৬ কোটি মানুষের প্রাণ সাকিব আল হাসান, তামিমিয়ান্স, টাইগারিয়ান্স ও টাইগার স্কোয়াড; এই দশ গ্রুপ প্রতিনিধিত্ব করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সকল অনলাইন গ্রুপ কে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা পাঁচ ফ্যানকে সম্মাননায় ভূষিত করেছে বিসিএসএ। পুরষ্কারপ্রাপ্ত পাঁচজন ছিলেন শোয়েব আলি বুখারী, বিসিএসরই ভাইস প্রেসিডেন্ট তানভির আহমেদ, খোরশেদ মাদবর আলমগীর, মেজর তানিম হাসান এবং মোহাম্মদ শাহীন। ভক্ত সংগঠন হিসেবে বিসিএসএ’র যুক্তরাজ্য শাখাকেও পুরস্কৃত করা হয়েছে।
এছাড়া ‘স্পোর্টস স্কুল’র তত্ত্বাবধানে ফেস্টিভ্যালে ক্রিকেট সাংবাদিকতা, ধারাভাষ্য এবং উপস্থাপনা নিয়ে ছিল আলাদা কর্মশালা। দেশবরেণ্য সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি পেয়েছিল সফলতা।
২৪শে সেপ্টেম্বর থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর মোট চারদিনের বাকি গল্প লিখতে গেলে শব্দ ভান্ডার বোধহয় ফুরিয়েই যাবে। হলুদ জার্সিতে যেই বাঘগুলো মিরপুর থেকে শুরু করে পুরো দেশ আর দেশের বাইরে গ্যালারী কাঁপায় টাইগারদের জন্য গর্জনে, জাতীয় জাদুঘর তাদের কলকাকলিতে মেতেছিল শেষ চারদিন।
হাসিমুখে সফলভাবেই শেষ হয়েছে তৃতীয়বারের ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট ফেস্টিভ্যাল’র আয়োজন। কাল থেকে আর বিসিএসএ’র সদস্যরা ব্যস্ত হবেনা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে। জার্সিটা পরে দর্শনার্থীদের সামলানোর তাড়া থাকছেনা আর।
এরপরের অপেক্ষাটা এক বছরের। ২০১৮ সালে আরও দারুণ কিছু নিয়ে হাজির হওয়ার তাগিদটার শুরু আজ থেকেই। চলে যাওয়াটা এখনকার জন্যই, ফিরে আসাটা সব সময়ই আকাঙ্ক্ষিত। বিসিএসএ’র ক্রিকেট উৎসব আবারও ফিরবে নতুন কিছু নিয়ে, এবার যেমন ঘরে ফিরেছে নতুন কিছু দিয়েই। কারণ,
“চলে যাওয়া মানেই ফিরে আসা
কিছু দিয়ে কিছু নিয়ে যাওয়া”